মহাকাশের বিচিত্র অনবদ্য ছবি দেখে মুগ্ধ হয় না, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহ থাকুক বা না থাকুক, মহাকাশের এসব চিত্তাকর্ষক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে সত্যিই পারা যায় না। আজ কথা হবে মহাকাশের এসব হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য ধারণের পেছনের যন্ত্রটি নিয়ে। জ্যোতির্বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য নামটি নিঃসন্দেহে অতবিস্তারিত পড়ুন
মহাকাশের বিচিত্র অনবদ্য ছবি দেখে মুগ্ধ হয় না, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহ থাকুক বা না থাকুক, মহাকাশের এসব চিত্তাকর্ষক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে সত্যিই পারা যায় না। আজ কথা হবে মহাকাশের এসব হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য ধারণের পেছনের যন্ত্রটি নিয়ে। জ্যোতির্বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য নামটি নিঃসন্দেহে অতি পরিচিত। চমকপ্রদ এই যন্ত্রের নাম ‘হাবল টেলিস্কোপ’। এই টেলিস্কোপ গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথের দৃশ্য ধারণ করে থাকে। হাবল টেলিস্কোপ নক্ষত্রের জন্ম হতে দেখেছে, নক্ষত্রকে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছে, বহু দূরবর্তী ছায়াপথের দৃশ্য মুঠোয় এনে দিয়েছে, ধূমকেতুকে খণ্ড খণ্ড হয়ে যেতে দেখেছে, এবং সেই সাথে আরও অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে।
তবে এর নিজের ইতিহাসটা কী? কীভাবে উদ্ভাবিত হয়েছিল এই টেলিস্কোপ? কীভাবেই বা এটি ধারণ করে থাকে সুদূর মহাকাশের বিচিত্র চিত্র? আজকে সেই গল্পটাও আপনাদের জানানো হবে।
এর ভিত্তি মূলত গড়ে তুলেছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও। অনেকেই নিশ্চয়ই গ্যালিলিওর স্পাইগ্লাসের কথা শুনে থাকবেন। স্পাইগ্লাসের উদ্ভাবক গ্যালিলিও না হলেও এর কার্যক্রমের উন্নতিসাধন ও ব্যবহারে তার অবদান কম নয়। সহজ ভাষায়, স্পাইগ্লাস এমন একটি যন্ত্র, যা দূরবর্তী বস্তুকে কাছে থেকে দেখতে সহায়তা করে। ১৬১০ সালের দিকে গ্যালিলিও যখন স্পাইগ্লাস নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন তিনি শনির বলয়ের চিত্র টেলিস্কোপে ধরতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হন।
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে গ্যালিলিওর অবদান স্মরণীয়; Image Source: Biography.com
অপটিকসের উন্নতির সাথে সাথে ধীরে ধীরে গ্রহ-নক্ষত্রের চিত্রধারণেরও উন্নতি ঘটে। কিন্তু বহুদিন ধরে একটি সমস্যা থেকে যায়। আমাদের পৃথিবীকে ঘিরে যে বায়ুমণ্ডল রয়েছে, তা মহাকাশ থেকে আগত আলোকে বাধা দেয়ার কারণে সুনিপুণভাবে চিত্রধারণ সম্ভব হচ্ছিল না। এ সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একটি টেলিস্কোপ, যা ভূমিতে অবস্থিত টেলিস্কোপগুলোর সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সক্ষম। ১৯৬৪ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর, জ্যোতির্বিদ লাইম্যান স্পিটজার এমন একটি টেলিস্কোপ উদ্ভাবনের প্রস্তাবনা দেন। তবে ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্স থেকে সমর্থন পেতে এ প্রস্তাবনার কয়েক দশকের মতো সময় লেগে যায়। ১৯৬৯ সালে সংস্থাটি স্পেস টেলিস্কোপের রূপরেখা প্রদান করে এবং এর নির্মাণের নির্দেশনা দেয়।
এদিকে আমাদের অতি সুপরিচিত সংস্থা নাসা থেকেও এর জন্য পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে সংস্থাটি বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল। অবশেষে ১৯৭১ সালে ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্সের প্রশাসক জর্জ ল স্পেস টেলিস্কোপ টিমকে প্রস্তাবনার বাস্তবায়নের জন্য অনুমতি দেন এবং নাসা শীঘ্রই এ প্রচেষ্টার জন্য অর্থ তহবিলের তদবির করে। এ ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথমদিকে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়। পরবর্তীকালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ও কংগ্রেসের প্রচেষ্টায় আর্থিক সংকটের সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়। কিন্তু সমস্যা যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না। ১৯৮৬ সালে স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জারের ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাতজন নভোচারীর মৃত্যু হয়।
Image source: AP
এ ঘটনার কারণে টেলিস্কোপের প্রকল্প আরও পিছিয়ে পড়ে। কেননা, শাটল ফ্লাইট আবার শুরু না করা পর্যন্ত টেলিস্কোপের প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে স্পেস শাটলের উদ্ভাবনের মাধ্যমে ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল, পৃথিবীর সর্বপ্রথম স্পেস টেলিস্কোপের অবতারণা হয়।
Image Source: space.com
যা-ই হোক, প্রথম প্রচেষ্টাতেই কিন্তু মহাকাশের নিখুঁত চিত্রধারণ করা যায়নি। যন্ত্রপাতির বিভিন্ন ত্রুটির কারণে ধারণকৃত ছবিগুলো ছিল ঝাপসা। এর পেছনে মূল কারণ ছিল লেন্সের ত্রুটি। ১৯৯৩ সালে স্পেস শাটল সাতজনের একটি দলকে এ সমস্যা দূর করার জন্য পাঁচদিনের একটি মহাকাশযাত্রায় পাঠায়। এ সময় ওয়াইল্ড ফিল্ড প্ল্যানেটরি-২ সহ আরও দুটি নতুন ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে হাবল টেলিস্কোপ থেকে নতুন ছবি তোলা হয়, যেগুলো ছিল অত্যন্ত নিখুঁত ও চমকপ্রদ। এরপর থেকে সৌরজগতের বিভিন্ন চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করেছে হাবল টেলিস্কোপ।
হাবল টেলিস্কোপের তোলা মিল্কিওয়ের ছবি; Image Source: scitechdaily.com
হাবল টেলিস্কোপ ভূমিতে অবস্থিত অন্যান্য টেলিস্কোপের থেকে আলাদা নানা কারণেই। টেলিস্কোপটি দৈর্ঘ্যে প্রায় একটি স্কুল বাসের মতো, এবং ওজনে প্রায় দুটি হাতির সমতুল্য! বায়ুমণ্ডলের বাধাকে অতিক্রম করে এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বে আবর্তন করতে সক্ষম। একটি ডিজিটাল ক্যামেরার মাধ্যমে এই টেলিস্কোপ চিত্র ধারণ করে। পরে রেডিও কম্পাঙ্কের মাধ্যমে এসব চিত্র পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়।
হাবল টেলিস্কোপের চোখে ‘স্নো এঞ্জেল’; Image Source: space.com
এডউইন হাবল
প্রকৃতপক্ষে হাবল টেলিস্কোপের নামকরণ করা হয়েছে একজন ব্যক্তির নামে। তাহলে নিশ্চয়ই এমন কারও নামে করা হয়েছে, যিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে কোনো বিশাল অবদান রেখে গিয়েছিলেন? ঠিক তা-ই। এর নামকরণ করা হয়েছে আমেরিকান জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবলের নামানুসারে। হাবলকে আধুনিক কসমোলজির জনক বলা হয়। একসময় এমন ধারণা প্রচলিত ছিল যে, আমাদের নিজস্ব ছায়াপথ ‘মিল্কিওয়ে’ ব্যতীত অন্য কোনো ছায়াপথের অস্তিত্ব নেই। মহাকাশের নেবুলাকে সুনিপুণভাবে পর্যবেক্ষণ করে হাবল এ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন। তিনি দেখিয়েছেন, মহাকাশ আমাদের কল্পনার চেয়েও বহু দূর বিস্তৃত।
হাবল টেলিস্কোপের তোলা নেবুলার ছবি; Image Source: hyperaxion.com
আফসোসের ব্যাপার এ-ই যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিশাল অবদান রাখার পরও তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হতে পারেননি। তবে মহাকাশের বিচিত্র চিত্র ধারণকারী যন্ত্রটি আজ এডউইন হাবলের নামানুসারে উচ্চারিত হচ্ছে, এখানেই তার বিরাট সার্থকতা।
এডউইন হাবল; Image Source: Britannica
যেভাবে কাজ করে হাবল
হাবল টেলিস্কোপের নির্মাণের ইতিহাস তো জানা হলো। এখন পাঠকের নিশ্চয়ই জানার কৌতূহল হচ্ছে, কীভাবে এই টেলিস্কোপ কাজ করে? যারা জটিল বৈজ্ঞানিক জিনিসপত্র দেখলে ঘাবড়ে যান, তাদের ভয় পাবার কিছু নেই। এখানে মূলত টেলিস্কোপের প্রাথমিক কার্যকলাপ নিয়েই আলোচনা করা হবে।
প্রতি ৯৭ মিনিটে হাবল টেলিস্কোপ চার কিলোমিটার/সেকেন্ড বেগে পৃথিবীকে একবার আবর্তন সম্পন্ন করে, যা ১০ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রকে একবার প্রদক্ষিণ করার সমতুল্য। এই টেলিস্কোপ মূলত সৌরশক্তি দ্বারা পরিচালিত। ঘূর্ণনের সময় টেলিস্কোপটির দর্পণ আলো ধারণ করে এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে তড়িৎরূপে এই আলো প্রেরণ করে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক দর্পণে আলো আঘাত করে, যা পরবর্তী দর্পণে বাধা পেয়ে একটি ছিদ্রের মধ্য দিয়ে অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে এ আলোকে প্রেরণ করে। প্রতিটি যন্ত্রই ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য নিযুক্ত।
যন্ত্রপাতি
১) ওয়াইল্ড ফিল্ড ক্যামেরা: অতিবেগুনী, দৃশ্যমান এবং অবলোহিত রশ্মির অঞ্চলের আলো দেখতে পায়। ডার্ক এনার্জি, ডার্ক ম্যাটার, নক্ষত্রের জন্ম, ছায়াপথ গবেষণায় সহায়তা করে।
২) কসমিক অরিজিন্স স্পেকটোগ্রাফস: অতিবেগুনী রশ্মি শনাক্ত করতে পারে; প্রিজমের ন্যায় আচরণ করে ভিন্ন ভিন্ন আলো শনাক্ত করতে পারে।
৩) অ্যাডভান্সড ক্যামেরা ফর সার্ভে: দৃশ্যমান আলো দেখতে পারে, সৌরজগতের অপেক্ষাকৃত পূর্ববর্তী কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে সহায়তা করে।
৪) স্পেস টেলিস্কোপ ইমেজিং স্পেকটোগ্রাফ: তিন ধরনের আলোই দেখতে পারে এবং ব্ল্যাকহোল গবেষণায় সহায়ক।
৫) নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা অ্যান্ড মাল্টি অবজেক্ট স্পেকট্রোমিটার: হিট সেন্সর হিসেবে কাজ করে। ইন্টারস্টেলার ডাস্ট দিয়ে ঘেরা বস্তু দেখতে সহায়তা করে।
৬) ফাইন গাইডেন্স সেন্টার: মূলত নক্ষত্রের মধ্যবর্তী দূরত্ব এবং নক্ষত্রের গতি মাপতে সহায়ক।
হাবল টেলিস্কোপের যন্ত্রপাতি; Image Source: spacetelescope.org
পৃথিবীতে যেভাবে পৌঁছায় ছবি
একটি অ্যান্টেনার মাধ্যমে এসব তথ্য রেডিও কম্পাঙ্ক আকারে সংগৃহীত হয়। এ কাজে নিযুক্ত প্রকৌশলীরা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে টেলিস্কোপের সাথে যোগাযোগ সম্পন্ন করেন এবং বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এর জন্য মূলত দুটি প্রধান কম্পিউটার নিযুক্ত থাকে। এর মধ্যে একটি নির্দেশনা পরিচালনা করে এবং আরেকটি তথ্য সংগ্রহ ও প্রেরণের কাজ করে থাকে। অর্থাৎ, বিশাল যান্ত্রিক সমন্বয় ও কর্মীদের বাহিনী দ্বারা পরিচালিত হয় এ টেলিস্কোপের কার্যক্রম।
২০০৯ সালে জ্যোতির্বিদরা পঞ্চমবারের মতো হাবল টেলিস্কোপ পরিদর্শনে যাত্রা করেন এবং এতে নতুন যন্ত্রপাতি ও ক্যামেরা স্থাপন করেন। ২০২০ সালে টেলিস্কোপটির বয়স হলো ৩০ বছর, এবং এটি এখনও মহাকাশের চিত্তাকর্ষক চিত্র ধারণ করতে সক্ষম। তবে নাসা ‘জেমস ওয়েব’ নামের আরও অধিক উন্নতমানের একটি স্পেস টেলিস্কোপ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। সেটি হাবল টেলিস্কোপের স্থান দখল করবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হাবল টেলিস্কোপ যে বিশাল অবদান রেখেছে এবং এটি যে মহাকাশ গবেষণায় একটি মাইলফলকের নাম, তা নিঃসন্দেহে স্বীকার করতেই হবে।
সংক্ষেপে দেখুন
পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উদ্ভাবনগুলোর তালিকা করলে তার মাঝে অবশ্যই রাখতে হবে ‘বর্ণালীবীক্ষণ’ বা Spectroscope নামে একটি যন্ত্রকে। চাকা, প্রিন্টিং প্রেস, টেলিফোন, কম্পিউটার সহ অন্যান্য পরিচিত জিনিসের পাশে স্থান করে নেবে এটি। মানব সভ্যতার প্রেক্ষাপটে যন্ত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মানুষের কাবিস্তারিত পড়ুন
পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উদ্ভাবনগুলোর তালিকা করলে তার মাঝে অবশ্যই রাখতে হবে ‘বর্ণালীবীক্ষণ’ বা Spectroscope নামে একটি যন্ত্রকে। চাকা, প্রিন্টিং প্রেস, টেলিফোন, কম্পিউটার সহ অন্যান্য পরিচিত জিনিসের পাশে স্থান করে নেবে এটি। মানব সভ্যতার প্রেক্ষাপটে যন্ত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মানুষের কাছে বেশি পরিচিত নয়। গণহারে মানুষ এই যন্ত্রটিকে ব্যবহার করে না বলে অনেকেই এর গুরুত্ব নিয়ে ভাবে না। কেন এটি সেরা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার-উদ্ভাবনের মাঝে থাকবে, তা এই লেখাটিতে পরিষ্কার হবে।
রংধনু ও লাল সরণ
বর্ণালীবীক্ষণকে বলা যায় এক প্রকার রংধনু তৈরি করার যন্ত্র। দূরবর্তী নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি থেকে আগত আলোক রশ্মি এর ভেতরে প্রবেশ করলে এটি ঐ আলোকে বিস্তৃত বর্ণালীতে রূপান্তর করে দেয়। অনেকটা প্রিজমের মাধ্যমে সাদা আলো থেকে সাত রংয়ের আলোতে বিশ্লিষ্ট হবার মতো। তবে বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রটি নিউটনের প্রিজম থেকে আরো বেশি বিস্তৃত ও পরিশীলিত। এটি ব্যবহার করে এমনকি দূর-নক্ষত্রের আলো নিয়ে সূক্ষ ও সঠিক পরিমাপ করা যায়।
একটি বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র। ছবি: ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো
কীসের পরিমাপ? রংধনু আর বর্ণালীতে আবার মাপামাপির কী আছে? এখান থেকেই মজার জিনিসটা শুরু হয়। ভিন্ন ভিন্ন নক্ষত্র থেকে আসা আলো ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে, ভিন্ন ভিন্ন বর্ণালী তৈরি করে। বর্ণালীর এই বিষয়গুলো নক্ষত্র সম্পর্কে আমাদেরকে অনেক তথ্য প্রদান করে।
সচরাচর আমরা যে রং দেখি তার বাইরে কি আরো রং থাকতে পারে? দূরের নক্ষত্রগুলো কি আমাদের পরিচিত কোনো রঙের চেয়ে ভিন্ন ও অচেনা কোনো রঙের হতে পারে? না, সাধারণ মানুষের ক্ষমতায় এমন দেখা সম্ভব নয়। চোখের পক্ষে যতটুকু দেখার সামর্থ্য আছে, তার বাইরে দেখা সম্ভব নয়। রংধনুর সাত রং বেগুনী, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল আমরা দেখতে পাই। এর বাইরেও অনেক বৈচিত্র্যময় রং দেখে থাকি, তবে এগুলো ভিন্ন কোনো রং নয়। তিনটি মৌলিক রংয়ের বিভিন্ন আনুপাতিক মিশ্রণের মাধ্যমে এরকম হাজার হাজার বৈচিত্র্যময় রং তৈরি করা যায়। জগতে যত ধরনের রং দেখি, তার সবই আসলে তিনটি মৌলিক রঙের বিভিন্ন আনুপাতিক সমাবেশ মাত্র। এমনকি রংধনুর অতিরিক্ত চারটি রংও এই তিন রং থেকে তৈরি করা যায়। মৌলিক রং তিনটি হচ্ছে লাল, নীল ও সবুজ।
তিন মৌলিক রং লাল, নীল ও সবুজ (বড় বৃত্ত) এবং তাদের সমাবেশে তৈরি অন্যান্য রং (ছেদকৃত অংশ)। ছবি: স্টাডি ব্লু
নক্ষত্রে আমরা ব্যতিক্রম কোনো রং দেখতে পাবো না, অথচ পূর্বে উল্লেখ করেছিলাম ভিন্ন ভিন্ন নক্ষত্র ভিন্ন ভিন্ন রংধনু-বর্ণালী প্রদান করে। তাহলে এই বাক্য দিয়ে কী বোঝানো হয়েছিল? নক্ষত্র থেকে আগত আলো যখন বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রের ভেতর দিয়ে বিশ্লিষ্ট হয় তখন বারকোডের (Barcode) মতো অনেকগুলো সরু লাইনের সৃষ্টি করে। বিভিন্ন পণ্যের গায়ে পণ্যের পরিচিতি হিসেবে বারকোড ছাপানো থাকে। নক্ষত্রের আলো থেকে বিশ্লিষ্ট রেখা বর্ণালীকে আক্ষরিক অর্থেও ‘বারকোড’ বলা যায়। কারণ, বারকোড যেমন পণ্যের উৎপাদন, মেয়াদ, মূল্য, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে, তেমনই নক্ষত্রের আলোক বর্ণালী থেকেও নক্ষত্রের বয়স, গঠন, উপাদান ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।
বারকোড। ছবি: বারকোড গ্রাফিক্স
এমন না যে শুধুমাত্র দূরবর্তী নক্ষত্র থেকে আগত আলোক রশ্মিই বারকোড লাইন তৈরি করে, বিশেষ ক্ষেত্রে পৃথিবীতে উৎপন্ন আলোক রশ্মিও বারকোড লাইন তৈরি করতে পারে। সেই হিসেবে ল্যাবরেটরিতে এই আলোক রশ্মি বিশ্লেষণ করে আমরা কোনো অজানা পদার্থের পরিচয়ও বের করতে পারবো। এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করে বিভিন্ন অজানা পদার্থের পরিচয় বের করা হয়ও। যেমন, সোডিয়াম থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন আলোর বর্ণালীতে হলুদ রং বেশি প্রকট আকারে থাকে। সেই কারণে সোডিয়ামের আলো হলদেটে হয়ে থাকে।
স্পেকট্রোস্কোপের বর্ণালী। ছবি: ই-মেইজ
ঢাকার রাস্তায় রাতের বেলা ভ্রমণ করলে দেখা যাবে, অনেক স্থানে রাস্তা আলোকিত করে রেখেছে হলুদাভ একধরনের বাতি। কেউ যদি মাঝরাতে বিমানবন্দর থেকে রামপুরা যায়, তাহলে রাস্তা ফাঁকা পাবে। বাসে চড়লে একটার পর একটা হলুদ বাতি অতিক্রম করবে আর এর পেছনের বৈজ্ঞানিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে। এই হলুদ বাতিগুলো মূলত সোডিয়াম বাষ্পের আলো প্রদান করে। অন্যান্য মৌল অন্য রংয়ের আলো প্রদান করে। মৌল ভেদে আলোর রংয়ের তারতম্য কেন ঘটে কিংবা বিশেষ উপায়ে এসব মৌল কেন বর্ণালী প্রদান করে তা আবার পদার্থবিজ্ঞানের আরেক গল্প।
রাস্তায় ব্যবহার করা সোডিয়ামের আলোগুলো হলদেটে হয়ে থাকে। ছবি: নর্থ কোস্ট কারেন্ট
প্রথম উদাহরণ হিসেবে হাইড্রোজেন বর্ণালীর দিকে খেয়াল করি। নিচের ছবিটি হাইড্রোজেনের বর্ণালী নির্দেশ করছে। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে, হাইড্রোজেন চারটি রেখার সৃষ্টি করে। একটি বর্ণালীর বেগুনী অংশে, আরেকটি কালচে নীল অংশে, আরেকটি মলিন নীল অংশে এবং আরেকটি লাল অংশে।
হাইড্রোজেন বর্ণালী। ছবি: ডেভ ম্যাককেইন
বর্ণালীবীক্ষণ দিয়ে পরীক্ষা করলে কোন ধরনের বর্ণালী পাওয়া যাবে, তা নির্ভর করবে উৎস কোন অবস্থায় আছে কিংবা কীসের সাথে সংযুক্ত আছে তার উপর। তবে এসব ছাপিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, নির্দিষ্ট কোনো মৌলের জন্য রেখাগুলো সবসময় একই অবস্থানে থাকে। রেখা রঙিন হোক আর কালো হোক, তার অবস্থান সবসময় বর্ণালীর একই অবস্থানে থাকে।
বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে বসে সকল মৌলের বর্ণালী রেকর্ড করে রেখেছেন। তাই দূর নক্ষত্র থেকে আগত আলোক রশ্মির বর্ণালী বিশ্লেষণ করে এবং পরে তা রেকর্ড থেকে মিলিয়ে নিয়ে তারা বলে দিতে পারেন, নক্ষত্রটি কোন কোন উপাদান দিয়ে তৈরি।
বিজ্ঞানীরা সকল মৌলের বর্ণালী নির্ণয় করে রেখেছেন। ছবি: জিওফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি
তবে আপাত দৃষ্টিতে এখানে কিছু সমস্যার কথাও মনে হতে পারে। নক্ষত্র একাধিক মৌল দিয়ে গঠিত হতে পারে এবং এসব মৌল একসাথে তালগোল পাকিয়ে খিচুড়ি অবস্থা করে ফেলতে পারে। এমতাবস্থায় এদের থেকে আগত আলোক রশ্মি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে কিছু সমস্যা হবার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র বিশেষ উপায়ে এদেরকে আলাদা করে নিতে পারে। ফলে বড় একটি সমস্যার একদম জলের মতো সহজ সমাধান আমরা পেয়ে যাই। স্বীকার না করে উপায় নেই যে, এটি খুবই চমৎকার একটি যন্ত্র!
যে সকল নক্ষত্র আমরা দেখতে পাই, তাদের বেশিরভাগই আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত। রাতের আকাশে নক্ষত্রমণ্ডলীর বেশিরভাগই অবস্থিত আমাদের কাছাকাছিই অর্থাৎ আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সিতে। অল্প কিছু উজ্জ্বল বস্তু দেখা যায়, যারা দূরের অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে অবস্থিত। দূরের গ্যালাক্সির কোনো নক্ষত্রের সোডিয়াম বর্ণালী পরীক্ষা করে দেখলে অবাক করা কিছু পার্থক্য দেখা যাবে। নিচের ছবিটিতে তিনটি ভিন্ন স্থানের সোডিয়ামের বারকোড বর্ণালী দেখানো হয়েছে- উপরেরটি আমাদের পৃথিবীর, মাঝেরটি কাছের গ্যালাক্সির যেকোনো নক্ষত্রের এবং নিচেরটি দূরবর্তী নক্ষত্রের।
তিনটি ভিন্ন অবস্থানে সোডিয়াম বর্ণালীর পার্থক্য। ছবি: ডেভ ম্যাককেইন
উপরে পৃথিবীর বারকোডের সাথে নীচে দূরবর্তী নক্ষত্রের বারকোড তুলনা করলে তাদের অবস্থানের বেশ পার্থক্য দেখা যায়। অথচ উপরে বলা হয়েছিল বারকোডের অবস্থান সবসময় একই হবে। কিন্তু এখানে বারকোডের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন দেখাচ্ছে। এরকম হলে কীভাবে আমরা নিশ্চিত হবো যে, এগুলো আসলেই সোডিয়াম মৌলের বর্ণালী?
এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার খেয়াল করতে হবে যে, বর্ণালীর রেখাগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব একই। দূরে সরলে সম্পূর্ণ প্যাটার্নটিই দূরে সরেছে, কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যবর্তী দূরত্ব আগের মতোই আছে। শুধু সোডিয়ামের বেলাতেই নয়, অন্যান্য মৌলের বেলাতেও এরকম হয়। দূরবর্তী নক্ষত্রের বেলায় সেসব মৌলের বর্ণালীর সবটাই দূরে সরে যায় কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যবর্তী দূরত্ব সবসময় ঠিকই থাকে। সেই হিসেবে বর্ণালীর রেখা বা বারকোডের মধ্যবর্তী দূরত্ব বিশ্লেষণ করেও কোনো অজানা মৌলের পরিচয় জানা সম্ভব।
উপরের ছবিটির দিকে খেয়াল করলে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দেখা পাওয়া যাবে। পৃথিবীর প্যাটার্নের নিচে, মাঝের প্যাটার্নটি আমাদের গ্যালাক্সির কাছের নক্ষত্রগুলোর। এই নক্ষত্রগুলো থেকে আগত বর্ণালীরেখা লাল রঙের দিকে সরে যাচ্ছে। যদিও কাছের নক্ষত্রগুলোর বর্ণালী লালের দিকে সরে যাবার পরিমাণ খুব বেশি নয়। অন্যদিকে দূরের নক্ষত্রগুলোর বর্ণালীও লালের দিকে সরে যাচ্ছে, আর এখানে সরে যাবার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি।
সোডিয়ামের পাশাপাশি অন্য কোনো মৌলকে নিয়ে বিশ্লেষণ করলেও একই ঘটনার দেখা পাওয়া যাবে। সকলেই লালের দিকে সরে যাবে। গ্যালাক্সি যত দূরে অবস্থিত হবে, তাদের বর্ণালী লালের দিকে সরে যাবার পরিমাণ তত বেশি হবে। নক্ষত্রের বর্ণালীরেখা লাল রঙের দিকে সরে যাবার এই ঘটনাকে বলা হয় ‘লাল সরণ’। একে Hubble Shift বা হাবল সরণও বলা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবলের নামানুসারে এরকম নামকরণ করা হয়েছে। হাবলই দূরবর্তী নক্ষত্রের বেলায় প্রথম লাল সরণ আবিষ্কার করেছিলেন। বিভিন্ন গ্যালাক্সির অনেক বিখ্যাত ছবি হাবল টেলিস্কোপের মাধ্যমে তোলা, হাবল টেলিস্কোপের নামকরণও করা হয়েছে এডউইন হাবলের নামানুসারে।
এডউইন হাবল। ছবি: ই-মেইজ
এই লাল সরণ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সম্পর্কে আমাদেরকে ধারণা দেয়। ব্যাপারটি হচ্ছে বিগ ব্যাং। বিগ ব্যাংয়ের ফলে যে গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর দূরে সরে যাচ্ছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় লাল সরণ পর্যবেক্ষণ করে। গ্যালাক্সি যত দূরে অবস্থিত হবে, তার বর্ণালী লালের দিকে সরে যাবার পরিমাণও বেশি হবে। তাই কোনো গ্যালাক্সি যদি ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যেতে থাকে, তাহলে তার বর্ণালীও ধীরে ধীরে লালের দিকে সরে যেতে থাকবে। যদি কোনো গ্যালাক্সির বর্ণালী পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, এর বর্ণালী লালের দিকে সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, তাহলে ধরে নিতে হবে যে এই গ্যালাক্সিটি দূরে সরে যাচ্ছে। বর্ণালী লালের দিকে যত দ্রুত অগ্রসর হয়, সেটি তত বেশি বেগে দূরে সরে যায়।
বিজ্ঞানী এডউইন হাবল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখেছিলেন যে দূরবর্তী গ্যালাক্সির বর্ণালী লালের দিকে অগ্রসর হয়। গ্যালাক্সিগুলো যত দূরে অবস্থান করছে, লালের দিকে অগ্রসরের পরিমাণ তাদের তত বাড়ছে। তিনি ধরে নেন, যেহেতু লালের দিকে সরণ হচ্ছে, সেহেতু গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর দূরে সরে যাচ্ছে। এবং এটা হচ্ছে আনুপাতিক হারে। যেহেতু আনুপাতিক হারে সরে যাচ্ছে, তার মানে উল্টোদিকে গেলে এমন একটা সময়ের দেখা পাওয়া যাবে, যেখানে সমস্ত মহাবিশ্ব একত্রিত অবস্থায় ছিল। আর তাদের একত্র অবস্থা থেকে মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের চিন্তাধারাই পালটে দিয়েছিল এই আবিষ্কার। একই সাথে এ আবিস্কার মানুষের বাস্তবিক জগত এবং আত্মিক জগতেও অনেক প্রভাব রেখেছিল। আর অবশ্যই এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র বা স্পেকট্রোস্কোপ, তাই চাকা, প্রিন্টিং প্রেস, টেলিফোন কিংবা কম্পিউটারের মতোই সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন বলা যায় এই যন্ত্রটিকে।
সংক্ষেপে দেখুন