হোমপেজ/কোথায় অবস্থিত এ ব্যাংক ? কিভাবে কাজ করে?
সাইন আপ করুন
লগিন করুন
পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? আপনার ইমেইল এড্রেস দিন। ইমেইলের মাধ্যমে আপনি নতুন পাসওয়ার্ড তৈরির লিংক পেয়ে যাবেন।
আপনি কেন মনে করছেন এই প্রশ্নটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই উত্তরটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই ব্যক্তিকে রিপোর্ট করা উচিৎ?
খাদ্য সংকটে পড়লে রাইস ব্যাংক থেকে ৫০ হাঁড়ি পর্যন্ত ধান ধার নিতে পারে যে কেউ। পরের বছর জুমের ধান তোলার পর ১০ হাঁড়ির বিপরীতে ১৩ হাঁড়ি করে (১০ হাঁড়ি ধান নিলে বাড়তি ৩ হাঁড়ি দিয়ে শোধ করতে হয়) ধান শোধ করতে হয়। থানচির দুর্গম এলাকায় একটি বিশাল জুমক্ষেত বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের বড়মদক এলাকাবিস্তারিত পড়ুন
বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের বড়মদক এলাকায় ‘রাইস ব্যাংক’ -এর মাধ্যমে খাদ্য সংকট মোকাবেলা করে থাকেন জুমচাষীরা। বড়মদক মূলত মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা। থানচি উপজেলা সদর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সেখানে যেতে লাগে চার ঘণ্টার মতো সময়। সেখানে এক পাড়ায় এখনও দুটি রাইস ব্যাংক চালু রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে ১৮ বছর আগে এই দুটি রাইস ব্যাংক চালু করা হয় বলে জানিয়েছেন চাষীরা।
প্রতি বছর জুন থেকে আগস্ট মাসে খাদ্য সংকটে পড়ে অধিকাংশ জুমচাষী। জুন-জুলাই মাসে একদিকে যেমন থাকে ভরা বর্ষাকাল। বাইরে কাজের তেমন সুযোগ পায় না। অন্যদিকে জুমের নতুন ধান গোলায় উঠতেও দেরী। এসময় খাদ্য সংকটে পড়ে ধারদেনা করে চলতে হয় অনেক জুমিয়াদের। দুর্গম এলাকায় অনেকেই উপায় না পেয়ে ‘দাঁদন টাকা’ নেন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। ‘দাঁদন’ টাকা নেওয়ার পর ওই নির্দিষ্ট টাকার পরিমাণে জুমের ধান, তিল, কাউন কিংবা যে কোন জুমের ফসল দিয়ে পরিশোধ করতে হয়।
জুমের নতুন ধান ঘরে তোলার পর সবাই মিলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান জমা করে রাখা হত একটি ঘরে। যাতে জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত আপদকালীন খাদ্য সংকট মোকাবেলা করতে পারে জুমচাষীরা। দুর্গম এলাকায় এভাবে গড়ে উঠেছিল ‘রাইস ব্যাংক’ ধারণাটি। খাদ্য সংকটে পড়লে সেখান থেকে দশ থেকে পঞ্চাশ হাঁড়ি পর্যন্ত ধান ধার নিতে পারে যে কেউ। পরের বছর জুমের ধান তোলার পর দশ হাঁড়ির বিপরীতে তের হাঁড়ি করে (১০ হাঁড়ি ধান নিলে বাড়তি ৩ হাঁড়ি দিয়ে শোধ করতে হয়) ধান শোধ করতে হয়। এছাড়া তুলনামূলক কম টাকায় কিনতে পারে এই ধানও। সবকিছু কাগজে-কলমের মাধ্যমে সে হিসাব রাখে রাইস ব্যাংক পরিচালনা কমিটি।
একসময় রাইস ব্যাংক পরিচালনার জন্য নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছিল জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা-ইউএনডিপি। সে সময় বান্দরবানের সাত উপজেলায় বিভিন্ন পাড়ায় ইউএনডিপির উদ্যোগে ৫৮৪টি রাইস ব্যাংক গড়ে উঠেছিল। তবে পাহাড়ে অধিকাংশ এলাকায় দিন দিন জুমের আবাদ কমে যাচ্ছে। জুমচাষীর সংখ্যাও কমে আসায় সেই রাইস ব্যাংক আগের মত চালু নেই। অনেক জায়গায় একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু কিছু কিছু দুর্গম এলাকায় ‘রাইস ব্যাংক’ এখনও ভালোভাবে টিকে আছে। বিশেষ করে রাইস ব্যাংকের কারণে আপদকালীন খাদ্য সংকট মোকাবেলা করতে পারে অনেক জুমচাষী।
তবে কেবল জুমচাষী নয়, পাড়ার অন্যান্য যে কেউ খাদ্য সংকটে পড়লে রাইস ব্যাংক থেকে ধান ধার নিতে পারে। এমনকি ধার নিতে পারে নগদ টাকাও। ধান ও নগদ টাকা ধারদেনার হিসাব করে রাখেন রাইস ব্যাংক পরিচালনা কমিটি।
সম্প্রতি বড়মদক ভিতরপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অল্প কয়েক গজের ব্যবধানে দুটি রাইস ব্যাংক রয়েছে। দুটি ‘রাইস ব্যাংক’ বাঁশের বেড়া দিয়ে টিনের ছাউনি ঘর। মাটি থেকে সামান্য উপর করে তৈরি করা হয়েছে ঘর দুটি। একটি রাইস ব্যাংকে ১০০-১৫০ হাঁড়ির মত ধান রয়েছে। অপরটিতে কোন ধান অবশিষ্ট নেই। জুমচাষীরা যে যার চাহিদা অনুযায়ী ধার করে নিয়েছে।
বড়মদক ভিতরপাড়া বাসিন্দা সিংদাই মারমা নামে এক নারী জুমচাষি বলেন, এ বছর মে-জুন মাসের দিকে ঘরের খাবার একটু টান পড়ে যায়। রাইস ব্যাংক থেকে ৩০ হাঁড়ি ধার নিয়েছি। নতুন ফসল তোলার পর শোধ করে দিয়েছি। ৩০ হাঁড়ি ধানে বাড়তি হিসেবে আরও ৯ হাঁড়ি ধান দিতে হয়েছে। আবার টাকা থাকলে ধানও কেনা যায়। এক হাঁড়ি ধান ২৫০ টাকা করে কিনতে পাওয়া যায়।
বড়মদক ভিতরপাড়ার আরেক বাসিন্দা স্ইুলুংমং মারমা বলেন, জুলাই মাসে স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছি। হঠাৎ টাকা প্রয়োজন। রাইস ব্যাংক কমিটি থেকে ১৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছি। এ বছর ঠিকমত জুমচাষও করা যায়নি। আগামী বছর এক সাথে সব টাকা পরিশোধ করা হবে।
এবারে ভারী বৃষ্টিতে জুমক্ষেত নষ্ট হয়েছে। কোনরকমে খাওয়ার মত ধান পেয়েছে্ন। ৩০ হাঁড়ি ধান রাইস ব্যাংক থেকে ধার নেওয়া ছিল। ভাল ধান না পাওয়ায় এ বছর পরিশোধ করা যায়নি। আগামী বছর জুমধান পেলে পরিশোধ করা হবে বলে জানান মংমং মারমা নামে বড়মদক পাড়ার আরেক জুমচাষী।
মংদাক মারমা নামে আরেক জুমচাষী জানান, তিনিও এ বছর ২০ হাঁড়ি ধান ধার নিয়েছেন। ফসল ঘরে তোলার পর ২৬ হাঁড়ির (১০ হাঁড়িতে বাড়তি ৩ হাঁড়ি ধান পরিশোধ করতে হয়) ধান পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে। জুমের ধান ঘরে তোলার আগে কোন কোন বছর খাবারের একটু টান পড়ে। আবার কোন বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে ধান সব নষ্ট হয়ে যায়। এ সময় একমাত্র ভরসা রাইস ব্যাংক।
অংথোয়াইসা মারমা নামে আরেক জুমচাষি জানিয়েছেন, তিনিও এ বছর জুলাই মাসে ১০ হাঁড়ি ধান নিয়েছিলেন। জুমের ধান তোলার পর পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জুমচাষ করে আগের মত ভাল ধান পাওয়া যায় না। অনেক দূরে গিয়ে চাষ করতে হয়। কোন কোন সময় বছর খোরাকি ধান উঠে না। এ কারণে বাধ্য হয়ে রাইস ব্যাংক থেকে ধান ধার করে চলতে হয়।
রেমাক্রি ইউনিয়নের বড়মদক ভিতরপাড়ায় ১৫০টির মত পরিবার রয়েছে। দুর্গম এ পাড়ায় অধিকাংশই জুমচাষের মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করে থাকে। সেখানে দুটি রাইস ব্যাংক পরিচালনার জন্য রয়েছে আলাদা দুটি কমিটিও। কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিলে মোট চারজন সদস্য রয়েছে।
পাড়ার একটি ‘রাইস ব্যাংক’ কমিটির সভাপতি সাচিংপ্রু মারমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ধার দেওয়া ধান সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহ বলতে যারা ধার নিয়েছে তারা নিজেরাই এসে দিয়ে যায়। কারণ এ সময় সবাই জুমের নতুন ফসল ও ধান ঘরে তুলে। কেউ দশ হাঁড়ি ধান নিলে পরের বছর বাড়তি তিন হাঁড়ি ধান শোধ করতে হয়। এভাবে করে কেউ বিশ হাঁড়ি ধান নিলে পরের বছর ওই বিশ হাঁড়িসহ বাড়তি আরও ছয় হাঁড়ি ধান শোধ করতে হবে। অনেকেই জুমের ধান খারাপ হলে ঠিকমত পরিশোধ করতে পারে না। তখন আমরা পরের বছর নিয়ে থাকি।”
”বছরে একটা বিশেষ সময় খাদ্য সংকট মোকাবেলা করার জন্য এই রাইস ব্যাংক চালু হয়েছে। আবার কেউ নগদ টাকা ধার নিয়ে থাকলে টাকাও সংগ্রহ করি। টাকা শোধ করতে হয় প্রতি হাজারে ১০০ টাকা বাড়তি করে। ধান হলে যে কোন বছর যে কেউ পরিশোধ করতে পারে। কারণ সবাই জুমচাষ করে। তবে নগদ টাকা ধার দেওয়ার সময় একটু হিসাব করে দিই। তবে পাড়াবাসী হিসেবে আমরা সবাইকে চিনি কার কেমন সামর্থ্য। কাকে কত টাকা দেওয়ার দরকার সে হিসাব করে টাকা দিয়ে থাকি”, বলেন তিনি।
“বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া সাধারণত চার-পাঁচ হাজার টাকার বেশি দেওয়া হয় না। টাকা কিংবা ধান একেবারে কেউ পরিশোধ করেনি এরকম কখনও হয়নি। জুমের ফসল ভাল না পেলে হয়ত কোন বছর সময়মত টাকা দিতে পারেনা। কিন্তু পরের বছর ঠিকই পরিশোধ করে”, বলেন কমিটির সভাপতি সাচিংপ্রু মারমা।
বড়মদক ভিতরপাড়ার আরেকটি ‘রাইস ব্যাংক’ -এর পরিচালনা কমিটির সভাপতি সিংমং মারমা জানান, “আমাদের রাইস ব্যাংকে মোট দুই হাজার হাঁড়ি পর্যন্ত ধান রাখা যায়। তবে বছরে সবসময় এক হাজার হাঁড়ি পর্যন্ত ধান জমা থাকে। সেখান থেকে যার যার চাহিদা অনুযায়ী ধান ধার দেওয়া হয়। এগুলো লিখিতভাবে হিসাব করে রাখি। জুমধান ঘরে তোলার পর নিজেদের উদ্যোগে ধান পরিশোধ করে থাকে তারা।”
”সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বরে পরিশোধ করার কথা থাকলেও অনেকেই দেরী করে পরিশোধ করে। কারণ এলাকা থেকে দূরে গিয়ে জুমচাষ করতে হয়। ঘরে নিয়ে আসতে অনেক দেরী হয়। তবে রাইস ব্যাংক চালু হওয়ার ১৮ বছরের মধ্যে ধান পরিশোধ করেনি এরকম মাত্র চার-পাঁচজন রয়েছে। তাদেরকে সমিতি থেকে একেবারে বাদ দেওয়া হয়েছে।”
রেমাক্রি ইউপি চেয়ারম্যান মুইশৈথুই মারমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, জুমচাষী ও পাড়াবাসীরা রাইস ব্যাংক থেকে উপকৃত হচ্ছে। বছরে বিশেষ একটা সময় জুমধান কাটার আগে দুই থেকে তিন মাস অনেকে খাবারের অভাবে থাকে। তখন রাইস ব্যাংক থেকে ধান ধার করে চলতে পারে। দুর্গম এলাকায় এভাবে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে রাইস ব্যাংক ভূমিকা রাখে। আর ভূমিকা রাখে বলেই রাইস ব্যাংকটি ১৮ বছর ধরে চালু আছে।
তিনি বলেন, ”ইউএনডিপি থাকতে তাদের সহযোগিতায় বিভিন্ন এলাকায় রাইস ব্যাংক চালু ছিল। কিন্তু নানা কারণে পাড়াবাসীরা চালু রাখতে পারেনি। বড়মদক পাড়ায় দুটি রাইস ব্যাংক টিকে আছে। এছাড়া বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় আরও থাকতে পারে”।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এম এম শাহ নেওয়াজ বলেন, “দুর্গম বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে যেখানে জুমচাষীরা রয়েছে তারা নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তার প্রয়োজনে ‘রাইস ব্যাংক’ গড়ে তুলেছে। তবে সেখানে কৃষি বিভাগের কোন সংশ্লিষ্টতা নাই।”