হোমপেজ/ক্যালকুলাস
সাইন আপ করুন
লগিন করুন
পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? আপনার ইমেইল এড্রেস দিন। ইমেইলের মাধ্যমে আপনি নতুন পাসওয়ার্ড তৈরির লিংক পেয়ে যাবেন।
আপনি কেন মনে করছেন এই প্রশ্নটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই উত্তরটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই ব্যক্তিকে রিপোর্ট করা উচিৎ?
বিজ্ঞানের হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক তত্ত্বই যুগপৎভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন- মাইকেল ফ্যারাডে ও জোসেফ হেনরির ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন আবিষ্কার ছিল সমসাময়িক। এরপর চার্লস ডারউইন ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস একই সময়ে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন’ তত্ত্বের ধারণা প্রদান করেন। এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।বিস্তারিত পড়ুন
বিজ্ঞানের হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক তত্ত্বই যুগপৎভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন- মাইকেল ফ্যারাডে ও জোসেফ হেনরির ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন আবিষ্কার ছিল সমসাময়িক। এরপর চার্লস ডারউইন ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস একই সময়ে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন’ তত্ত্বের ধারণা প্রদান করেন।
এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর একটিও আইজ্যাক নিউটন ও গটফ্রেড লিবনিজের ক্যালকুলাস তত্ত্বের মতো বিতর্কিত হয়নি। বর্তমানে নিউটন ও লিবনিজ দুজনকেই ক্যালকুলাসের জনক বলা হয়। কিন্তু একসময় এই তত্ত্ব নিয়ে দুই গণিতবিদ বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। তাদের দুজনের মধ্যে কে সবার আগে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছেন, সেটি ছিল বিবাদের মূল কারণ। এই বিতর্ককে ঘিরে বেশ কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি হয়েছিল, যেটা বেশ কয়েক বছর চলমান ছিল।
গণিতের বিতর্কিত এক অধ্যায়ের সাথে জড়িয়ে আছে নিউটন ও লিবনিজের নাম
ব্যারো নামে আইজ্যাক নিউটনের একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি ক্যালকুলাস সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে কিছু ধারণা প্রদান করেন। কিন্তু তিনি তখন ক্যালকুলাসের তাৎপর্য বুঝতে পারেননি। সেই কারণে তিনি এই বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেননি এবং তার প্রাথমিক ধারণাগুলোও জনসম্মুখে প্রকাশ করেননি। কিন্তু নিউটন যেহেতু ব্যারোর ছাত্র ছিলেন, সেই সূত্রে তিনি তার শিক্ষকের কাছে থেকে ক্যালকুলাসের সামান্য কিছু ধারণা পান। পরবর্তীতে তিনি তার শিক্ষকের দেয়া ধারণাকে কাজে লাগিয়ে ক্যালকুলাসের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কার করেন।
কিন্তু আইজ্যাক নিউটন প্রথম থেকেই কিছুটা প্রচারবিমুখ ছিলেন। তিনি তার আবিষ্কৃত বিভিন্ন তত্ত্ব জনসম্মুখে প্রকাশ করতে পছন্দ করতেন না। একই কাজ তিনি ক্যালকুলাসের ক্ষেত্রেও করেন। সপ্তদশ শতকের ষাটের দশক থেকে তিনি ক্যালকুলাস নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন এবং ১৬৬৪-৬৬ সালের মধ্যে তিনি ক্যালকুলাসের মূল বিষয়গুলো আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। এরপর নিউটন ১৬৬৯, ১৬৭১ ও ১৬৭৬ সালে ক্যালকুলাস নিয়ে ৩টি আলাদা গবেষণাপত্র লেখেন। কিন্তু তিনি সেগুলোর একটিও সেই সময়ে প্রকাশ করেননি। ১৬৬৯ সালে তিনি যে তত্ত্ব লেখেন, সেটি প্রকাশ হয় ১৭১১ সালে, অর্থাৎ ৪২ বছর পর। দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় ১৭৩৬ সালে, তার মৃত্যুরও ৯ বছর পর। তবে সর্বশেষ তত্ত্বকোষটি তিনি ১৭০৪ সালে প্রকাশ করেন।
স্যার আইজ্যাক নিউটন
অষ্টাদশ শতকের আগে ক্যালকুলাস নিয়ে নিউটনের কোনো তত্ত্বই জনসম্মুখে প্রকাশ হয়নি। তবে ১৬৮৪ সালে লেইপজিগ সাময়িকীতে তিনি ক্যালকুলাস নিয়ে ‘অ্যাক্টা এরুডিটোরাম‘ নামে একটি অসমাপ্ত গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি তার আবিষ্কৃত তত্ত্বসমূহ গোপনে বন্ধুদের মাঝে চিঠি আকারেও বিলি করতেন। এই চিঠিগুলোর একটি লিবনিজও পেয়েছিলেন। তবে সেই চিঠিতে নিউটন ক্যালকুলাস সম্পর্কে যা লিখেছিলেন, সেটি পুরো অস্পষ্ট ছিল। এছাড়া অনেক বিষয় তিনি ইচ্ছা করে এড়িয়ে যান, যাতে কেউ তার তত্ত্ব চুরি করতে না পারে। অন্যদিকে, সপ্তদশ শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে লিবনিজও ক্যালকুলাস আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। ১৬৭৪ সালে তিনি ক্যালকুলাস নিয়ে তার চিন্তাভাবনাকে প্রকাশ করতে শুরু করেন এবং ১৬৮৪ তিনি এই বিষয়ে লিখিত আকারে তত্ত্ব প্রকাশ করেন। কিন্তু তার ছয় পৃষ্ঠার সেই তত্ত্বটি বেশ অস্পষ্ট এবং অনেকের কাছে বোধগম্য ছিল না। তবে সেই সময়ে ক্যালকুলাস নিয়ে তার তত্ত্বটি সঠিক ছিল।
গটফ্রেড লিবনিজ
বিতর্কের আদ্যোপান্ত
প্রথমদিকে নিউটন ও লিবনিজ দুজনেই একে অপরকে ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক হিসেবে সম্মান করতেন। কিন্তু তাদের একজন বন্ধু বিখ্যাত দুই গণিতবিদকে মুখোমুখি দাঁড় করান। ১৬৯৬ সালে লিবনিজের একজন বন্ধু নিউটনকে তার ক্যালকুলাস তত্ত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। তিনি ভেবেছিলেন, নিউটন তার উত্থাপিত সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। কিন্তু নিউটন ও লিবনিজ উভয়ই সেই সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হন। কিন্তু এই ঘটনার পর লিবনিজ এক প্রবন্ধে নিউটনের এক বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তিনি ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক এবং এ বিষয়ে নিউটন তার শিষ্য। নিউটনের বন্ধু বিষয়টি পুরোপুরি হজম করতে পারেননি। তিনি বেশ রাগের সাথে পূর্বে উত্থাপিত সমস্যার বিচার বিশ্লেষণ তুলে ধরেন এবং পরোক্ষভাবে লিবনিজের বিরুদ্ধে নিউটনের লেখা চুরির অভিযোগ করেন।
তিনি প্রমাণ হিসেবে বহু বছর আগে লিবনিজের কাছে ক্যালকুলাস নিয়ে নিউটনের পাঠানো চিঠিকে সামনে আনেন। কিন্তু মূলত সেই চিঠিতে নিউটন ক্যালকুলাস নিয়ে নিজের তত্ত্বের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যাই প্রদান করেননি। এরপর বেশ কয়েক বছর এই বিষয়টি চাপা পড়ে ছিল। কিন্তু ১৭০৫ সালে লিবনিজ নিউটনের ক্যালকুলাস সম্পর্কিত কিছু কাজ রিভিউ করে নিজেদের দুজন বিজ্ঞানীর সাথে তুলনা করেন, যারা উন্নততর কিছু আবিষ্কারের উদ্দেশ্য জুটি বেঁধেছিলেন। কিন্তু নিউটনের একজন বন্ধু লিবনিজের এই বিষয়টিকে লেখা চুরির নতুন ফন্দি হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। সম্ভবত লিবনিজ যে দুজন বিজ্ঞানীর উদাহরণ টেনেছিলেন, তারা একে অপরের তত্ত্ব চুরি করেছিলেন।
লন্ডনের বিখ্যাত রয়্যাল সোসাইটি
এই ঘটনার কিছুদিন পরেই নিউটনের সেই বন্ধু লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি থেকে একটি দলিল প্রকাশ করেন এবং সেখানে তিনি নিউটনকে সন্দেহাতীতভাবে ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই সাথে তিনি লেখেন, লিবনিজ নিউটনের তত্ত্ব চুরি করেছেন এবং কিছু কাটছাঁট করে নিজের নামে তা প্রকাশ করেছেন। এই বিষয়টি লিবনিজের জন্য ছিল চরম অপমানজনক। তিনি বেশ ক্রুদ্ধ হয়ে রয়্যাল সোসাইটি বরাবর চিঠি লিখে ক্ষমা চাইতে বলেন। কিন্তু ক্ষমা তো দূরে থাক, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে লিবনিজকে প্রতি আক্রমণ করে চিঠি পাঠানো হয় এবং সেখানে তার প্রতি সমস্ত অভিযোগের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। জবাবে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চেয়ে লিবনিজ আরো একটি চিঠি পাঠান।
রয়্যাল সোসাইটি লিবনিজের দাবির পক্ষে সাড়া দেয়। তারা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই সময়ে রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি ছিলেন আইজ্যাক নিউটন। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি সেই কমিটির সদস্য হিসেবে না থাকলেও, তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেটি পুরোপুরি তার পক্ষে ছিল। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, তদন্ত প্রতিবেদনটি নিউটন নিজ হাতে লিখেছিলেন। সেখানে তিনি নিজেকে ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক হিসেবে তুলে ধরেন এবং লিবনিজ তার তত্ত্ব চুরি করেছেন বলে প্রতিবেদনে লেখেন।
এ নিয়ে রয়েছে অনেক রম্য কার্টুন
লিবনিজ ও তার বন্ধুদের জন্য এটি ছিল অনেক বড় পরাজয়। তারা নিউটনের বিপক্ষে বিভিন্ন প্রমাণ সংগ্রহ করে নিজেদের দাবির পক্ষে লিফলেট প্রকাশ করে প্রচার করেন। এর বেশ কয়েক বছর পরও গণিতশাস্ত্রের অন্যতম সেরা দুই বিজ্ঞানী একে অপরের বিপক্ষে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ অব্যাহত রাখেন এবং পূর্বে প্রকাশিত যুক্তিতর্কগুলো পরিমার্জন করে প্রকাশ করতে থাকেন। এমনকি লিবনিজের মৃত্যুর পরও তার বিরুদ্ধে নিউটনের তত্ত্ব চুরির অভিযোগের উপর বিভিন্ন যুক্তিতর্ক ও প্রমাণ প্রচার করা হয়।
এত বিতর্কের পরও বিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত নিউটন ও লিবনিজ উভয়কে ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক হিসেবে মানা হতো। কিন্তু গত শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানীরা একমত হন যে, নিউটন সর্বপ্রথম ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছেন। তিনি ১৬৬৫-৬৬ সালে দিকে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন। তবে লিবনিজ নিউটনের সাথে কোনো যোগাযোগ ব্যতিরেকে নিজ প্রচেষ্টায় ১৬৭৫-৭৬ সালে ক্যালকুলাসের মূল নীতিসমূহ আবিষ্কার করেন।
ক্যালকুলাস বিতর্ক নিয়ে ট্রল
তবে দিন শেষে প্রকৃত বিজয় হয়েছে লিবনিজেরই। কারণ নিউটন যে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন, সেটি ছিল বড্ড সেকেলে। ফলে সেটি ইতোমধ্যে জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। তবে লিবনিজের ক্যালকুলাস ছিল বাস্তবভিত্তিক। বর্তমানে স্কুল-কলেজে যে ক্যালকুলাস চর্চা করা হয়, তার শতকরা ১০০ ভাগই লিবনিজের আবিষ্কৃত ক্যালকুলাস। ফলে তিনি ক্যালকুলাসের দ্বিতীয় আবিষ্কারক হলেও তার সৃষ্টিকর্মই স্থায়ীত্ব লাভ করেছে।
বিজ্ঞানের সূচনালগ্ন থেকেই হয়তো নানা বিষয়ে নানা বিজ্ঞানী বা গবেষকের মধ্যে মতামত কিংবা তত্ত্বের অমিল হয়েছে, কিংবা কারো কারো ক্ষেত্রে তাঁদের একজনের গবেষণার সাথে হয়তো আরেকজনের গবেষণা কাজের মধ্যে অনেক মিল লক্ষ করা গেছে। এই নিয়ে হয়তো তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও হয়েছে বেশ। এরকমটা হতেই পারে। বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাঁটলে এরকম অনেকগুলো তত্ত্ব বা আবিষ্কার পাওয়া যাবে যা নিয়ে হয়তো দুই গবেষক বা বিজ্ঞানীর মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়েছে যে, কে সেই তত্ত্ব বা আবিষ্কারের আসল জনক?
সেরকম এক বিতর্কের জন্ম হয়েছিলো ১৭ শতকে। বিষয় হলো ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক কে এই নিয়ে। যারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে বা পড়েছে, কিংবা অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন, তারাই ক্যালকুলাস সম্বন্ধে জ্ঞান রাখেন। অনেকের কাছেই গণিতের এই শাখা খুবই জটিল বলে বিবেচিত হয়। তো যে জিনিসের আবিষ্কারক নিয়েই বিতর্ক, সেটা জটিল হলে বেমানান হবে না একেবার। আগের কথায় ফিরে আসা যাক। ১৭ শতকের দিকে বিজ্ঞানী নিউটন ও গণিতবিদ লিবনিজের মধ্যে ইনফিনিটেসিমাল ক্যালকুলাস আবিষ্কার নিয়েই বিতর্কের সৃষ্টি হয়। নিউটন ও লিবনিজ তাঁদের পরবর্তী জীবনে এই দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতায় মোটামুটি একধরনের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পড়েন।
মহামতি নিউটন
বর্তমানে আমরা সাধারণত কোনো গবেষণাপত্র যিনি আগে প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রকাশ করেন, তিনিই হন ঐ গবেষণার স্বত্বাধিকারী। কিন্তু সেসময়ে, অর্থাৎ ১৭ শতকে কিন্তু এই সুযোগ ছিলো না। ফলে সেসময়ে নিউটন এবং লিবনিজের উভয়ের মধ্যে স্বত্বাধিকার নিয়ে ভীতি অবশ্যই ছিলো। আর তাছাড়া সেসময়ে এক গবেষকের লেখা গবেষণাপত্র আরেক নীতিহীন গবেষক হয়তো চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিতেন। কাজেই নিজেদের গবেষণাপত্র নিয়ে বিজ্ঞানীগণ থাকতেন ভীত।
গণিতবিদ লিবনিজ
তো সেসময়ে কে হবেন গবেষণার জনক, এই বিষয়ে নীতি ছিলো যে নিকট বন্ধু কিংবা সহকর্মীর কাছে এই গবেষণার কথা বলা এবং কখনো কখনো নিজের ব্যক্তিগত নোটটিও দেখানো। এখন সেখানেও রচনা চুরির একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। এসবের কারণেই মূলত নিউটন এবং লিবনিজের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। তাঁরা দুজনেই মনে করতেন যে একজন আরেকজনের গবেষণা চুরি করেছেন। চলুন জানা যাক যে আসলে কে আবিষ্কার করলো ক্যালকুলাস; নিউটন? নাকি লিবনিজ?
ক্যালকুলাসের সূচনা যেখান থেকে
যদিও এখানে বলা হচ্ছে যে, ক্যালকুলাস আবিষ্কার নিয়ে নিউটন এবং লিবনিজের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কিন্তু তাঁরা আসলে কেউই ক্যালকুলাসকে নিজেদের বুদ্ধিমত্তার দ্বারা আবিষ্কার করেননি। কারণ ক্যালকুলাস আবিষ্কৃত হয়েছে আরো অনেক আগে। বরং বলা যায় যে, পূর্বতন গণিতবিদ, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কৃত কাজের শেষ পরিণতি দিয়েছেন নিউটন এবং লিবনিজ। তাঁরা ছড়ানো ছিটানো বিষয়গুলোকে একত্রিত করেছেন এবং একটি পরিপূর্ণ গণিতভিত্তিক রূপ প্রদান করেছেন।
প্রাচীনকালের অনেক গণিতবিদের চিন্তাধারাই ইন্টিগ্র্যাল ক্যালকুলাস বা সমাকলনের ধারণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিলো। যদিও সেই ধারণা যথাযথ সুসঙ্গত ও নিয়মতান্ত্রিক ছিলো না। খ্রিস্টপূর্ব ১৮২০ সালের দিকে মিশরে (Egyptian Moscow Papyrus) ক্ষেত্রফল ও আয়তন নির্ণয়ের জন্য ক্যালকুলাসের মতোই পদ্ধতি ব্যবহৃত হত। কিন্তু সূত্রগুলো ছিলো গুটিকয়েক বাস্তবসংখ্যার প্রেক্ষিতে, অর্থাৎ বাস্তবিক কোনো সূত্র ছিলো না। কিছু কিছু পদ্ধতি আপেক্ষিকভাবে সঠিক ছিলো, কিন্তু সেগুলোর সঠিক প্রতিপাদনও ছিলো না। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের গণিতবিদগণ ত্রিকোণমিতিকে অনেক সমৃদ্ধ করেছিলেন যা ‘সুল্বা সূত্র’ নামক গ্রন্থভুক্ত করা হয়। তাঁরা কয়েকটি ত্রিকোণমিতিক ফাংশনের প্রায় সঠিক ডিফারেন্সিয়েশন বা ব্যবকলন করতে সক্ষম হন।
বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের জন্য আর্কিমিডিসের পদ্ধতি
গ্রিসে ইউডক্সাস ‘মেথড অব এক্সাশন’ বা অবসাদ পদ্ধতি ব্যবহার করে ক্ষেত্রফল ও আয়তন নির্ণয়ের জন্য লিমিট ধারণার সূত্রপাত করেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস এই ধারণাকে আরো সুসংবদ্ধ ও উন্নত করেন এবং ‘হিউরিস্টিক’ (ন্যায়শাস্ত্রগত অনুসন্ধানবিদ্যা) প্রণয়ন করেন, যা ছিলো সমাকলনেরই প্রতিচ্ছবি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি বৃত্তের অন্তর্গত ক্ষেত্রফল নির্ণয় করতে সক্ষম হন। আর্কিমিডিস প্রথম অনিয়মিত বক্ররেখার স্পর্শক নির্ণয়ের জন্য এমন এক পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যা ব্যবকলনের সদৃশ। যখন তিনি সর্পিলাকার বক্ররেখা নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন তিনি পয়েন্ট মোশন বা বিন্দুগতিকে ২টি অংশে ভাগ করেন- (১) ব্যাসার্ধ গতি এবং (২) বৃত্তীয় গতি এবং উভয় প্রকার গতিকে সংযুক্ত করতে থাকেন। এভাবে বক্ররেখাটির স্পর্শক বের করেন।
চতুর্থ শতকে চীনে লিউ হু কর্তৃক মেথড অব এক্সাশন পুনরাবিষ্কৃত হয়। পঞ্চম শতকে Zu Chongzhi কর্তৃক আরো এক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়, যা পরবর্তীতে ক্যাভেলিয়ারি’স প্রিন্সিপাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই নীতির সাহায্যে গোলকের আয়তন নির্ণয় করা সম্ভব ছিলো।
প্রায় ১৭ শতক পর্যন্ত যতদিন না ‘Method of Indivisible’ আবিষ্কৃত হয় এবং সর্বোপরি নিউটন কর্তৃক সমাকলনের কাঠামো হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না হয়, ততদিন বিজ্ঞানীরা একে গ্রহণ করেননি।
নিউটন? নাকি লিবনিজ?
নিউটনের শিক্ষক এবং পূর্বসূরী ছিলেন ক্যামব্রিজের গণিত বিভাগের লুকাসিয়ান অধ্যাপক আইজ্যাক ব্যারো। ব্যারো তাঁর ‘জিওমেট্রিক্যাল লেকচারস’ গ্রন্থে ক্যালকুলাসের মৌলিক ধারণার কথা লিখে গেছেন। পরবর্তীতে নিউটন সেই নীতিগুলো সূত্রবদ্ধ করতে শুরু করেন। বিজ্ঞানী নিউটন ছিলেন গবেষণাপত্রের আবিষ্কার নিয়ে যেকোনো ধরনের বিতর্কবিরোধী। কিন্তু এই মনোভাবের ফলেই তিনি আসলে শেষপর্যন্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। প্রায় ১৬৬০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিজ্ঞানী নিউটন ক্যালকুলাস সম্বন্ধে তাঁর ধারণাগুলো সূত্রবদ্ধ করা শুরু করেন। ১৬৬৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ‘ফ্লাক্সিওন’ সম্পর্কিত তাঁর তত্ত্ব লিপিবদ্ধ করেন। তিনি এরপর ক্যালকুলাসের উপর বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র তৈরি করেন, কিন্তু তিনি সেগুলো কোথাও প্রকাশ করেননি তখন। ক্যালকুলাস সম্পর্কিত তাঁর অধিকাংশ গবেষণাপত্রই তখন অপ্রকাশিত থেকে যায়, যা প্রকাশিত হয় ১৮ শতকের শুরুর দিকে এসে। কিছু কিছু গবেষণাপত্র তাঁর মৃত্যুর পরেও প্রকাশিত হয়।
তো গবেষণা ও গবেষণাপত্রের কথা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, বিজ্ঞানী নিউটন বেশ আগেই ক্যালকুলাস সম্বন্ধে তাঁর গবেষণা ও অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁর গবেষণাপত্রগুলো ১৮ শতকের আগে প্রকাশ হয়নি। যদিও তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মীদের তাঁর কাজের সম্বন্ধে বলতেন। এখন ১৬৬৫-৬৬ সালে যখন নিউটন তাঁর ফ্লাক্সিওন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, তখন লিবনিজের বয়স ছিলো ২০ বছরের মতো। কাজেই তাঁর তখন গণিতের সত্যিকার জ্ঞান থাকা কিছুটা অসম্ভব। অন্ততপক্ষে ক্যালকুলাসের মতো একটা জটিল শাখা নিয়ে গবেষণা করা তো আরো অসম্ভব। তবে কি লিবনিজ নিউটনের গবেষণার মূল ধারণা চুরি করেছিলেন?
কে আবিষ্কার করলেন ক্যালকুলাস- নিউটন? নাকি লিবনিজ?
নিউটনের অনুসারীদের কথা বাদ দিয়ে যদি আমরা নিরপেক্ষ ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখা যাবে যে আসলে লিবনিজ নিউটনের কোনো তত্ত্ব বা ধারণা চুরি করেননি। তিনি স্বতন্ত্রভাবেই ক্যালকুলাস সম্পর্কে তাঁর ধারণা ও সূত্রসমূহ লিপিবদ্ধ করেন। তিনি এ সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেন ১৬৭০ সাল থেকে এবং ১৬৭৪ সালে তিনি এই সম্পর্কে তিনি সবাইকে বলেন। তিনি যে গবেষণাপত্রটি তৈরি করেছিলেন, সেটি প্রকাশিত হয় ১৬৮৪ সালে এসে। অর্থাৎ, প্রায় ১০ বছর পরে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। তাঁর গবেষণাপত্রের শিরোনাম ছিলো ‘A New Method for Maxima and Minima, as Well Tangents, Which is not Obstructed by Fractional or Irrational Quantities’ ৬ পৃষ্ঠার এই গবেষণাপত্রটি ছিলো বেশ অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য।
কিন্তু চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে যে, একদিকে নিউটন লিবনিজের বেশ কয়েক বছর আগেই তাঁর গবেষণা কাজ লিপিবদ্ধ করেছিলেন কিন্ত সেগুলো প্রকাশ পেয়েছিলো ১৮ শতকে এসে। অন্যদিকে লিবনিজ কাজ শুরু করেছিলেন নিউটনের বেশ কয়েক বছর পরে এসে। অথচ গবেষণাপত্র প্রকাশ করে ফেললেন নিউটনের আগে। ব্যাপারটা এখানে গোলমেলে হয়ে গেলো। কিন্তু নিউটন এবং লিবনিজ উভয়েই স্বতন্ত্রভাবে ক্যালকুলাস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন নিউটন যেহেতু আগে গবেষণা শুরু করেছিলেন, সেহেতু তাঁকে ধরা হলো প্রথম আবিষ্কারক এবং লিবনিজ ২য় আবিষ্কারক। সেটাও অমীমাংসিত থেকে গেলো। কারণ এখানে দুইজনেই আলাদা আলাদা ভাবে আবিষ্কার করেছে ক্যালকুলাস। কাজেই প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বলা হলে তাঁদের কোনো একজনকে হেয় করা হয়। বরং আমরা বলতে পারি তাঁরা দুইজন ক্যালকুলাসের সহ-আবিষ্কারক।
কিন্তু সেসময়ে মহামতি নিউটনের অনুসারীরা লিবনিজের বিরুদ্ধে গবেষণা চুরির অভিযোগ করেন। কেউ কেউ তাঁকে জার্মানির একজন বৈজ্ঞানিক গুপ্তচর হিসেবেও আখ্যায়িত করেন, যিনি কিনা জার্মানির বাইরের বিজ্ঞানীদের গবেষণা চুরি করে জার্মানিতে নিয়ে যান। লিবনিজ লন্ডনে এসেছিলেন কয়েকবার। এই ঘটনাকে তাঁরা গুপ্তচরবৃত্তির কারণ হিসেবেও দেখালেন নিউটনপন্থীরা। এভাবে ১৭ শতকের শেষের দিকে এসে এই দুই বিজ্ঞানী ক্যালকুলাস আবিষ্কার নিয়ে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হন।
এই বিতর্ক খুব জটিল হয়ে ওঠে একসময়। কিন্তু নিউটন সম্পর্কে লিবনিজ বলেন যে,
নিউটনের কাছে লেখা লিবনিজের চিঠি
লিবনিজ মাঝে মধ্যেই লন্ডনে আসতেন। নিউটন তাঁর গবেষণা সম্বন্ধে তাঁর নিকট বন্ধু ও সহকর্মীদের সাথে যে কথা বলতেন সে সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে। এঁদের অনেকেই ছিলো লিবনিজের ঘনিষ্ঠ। কাজেই নিউটনের অনুসারীরা মনে করেন যে লিবনিজ এঁদের কাছে ক্যালকুলাস সম্পর্কে নিউটনের কাজ সম্বন্ধে জেনেছেন। মজার ব্যাপার হলো, নিউটন এবং লিবনিজের মাঝে একসময় চিঠির আদান-প্রদান হতো নিয়মিত। তাঁরা তাঁদের চিঠিতে গণিত সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনা করতেন। নিউটন চিঠিতে লিবনিজকে তাঁর গবেষণা সম্বন্ধেও জানাতেন। যা-ই হোক, লিবনিজের অপ্রকাশিত গবেষণাপত্র পরীক্ষা করে জানা যায় যে নিউটনের সাথে সাহচর্য থাকার পরেও তিনি ক্যালকুলাসের গবেষণা করেছেন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে, যেখানে নিউটনের গবেষণার প্রভাব নেই।
লিবনিজ যখন গণিতের একজন শিক্ষানবিশ, তখন তিনি লন্ডনে আসেন। সেখানে তিনি নিউটনের সম্বন্ধে অল্প অল্প শোনেন। যদিও তিনি সরাসরি তখন নিউটনের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। কিন্তু রয়্যাল সোসাইটিতে নিউটনের দুজন বিশেষ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, হেনরি ওল্ডেনবার্গ এবং জন কলিনসের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখনো নিউটনের কাজ প্রিন্ট মাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। কাজেই লিবনিজ নিউটনের কাজ চাক্ষুষ দেখেননি। হতে পারে যে তিনি ওল্ডেনবার্গ ও কলিনসের আছে নিউটনের কাজ সম্পর্কে শুনেছিলেন।
লিবনিজ লন্ডন থেকে আইজ্যাক ব্যারোর ‘জিওমেট্রিক্যাল লেকচারস’ বইটি কিনে নিয়ে আসেন। পূর্বেই বলা হয়েছে যে ব্যারো ছিলেন নিউটনের শিক্ষক। তিনি এই বইতে ট্যানজেন্ট সম্পর্কে তাঁর ধারণা ও সূত্র লিপিবদ্ধ করেন যা মূলত ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের সাথে সম্পর্কিত। কাজেই নিউটনের অনুসারীরা লিবনিজকে এই দোষেও দোষারোপ করে যে তিনি ব্যারোর বই থেকে সাহায্য নিয়েছেন। অন্যদিকে লিবনিজের অনুসারীরা বলে যে, লিবনিজ এই বই পড়ার আগেই ক্যালকুলাস সম্বন্ধে গবেষণা শুরু করেছিলেন।
১৬৭৬ সালের জুন মাসে নিউটন ওল্ডেনবার্গের কাছে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠিতে তিনি তাঁর দ্বিপদী উপপাদ্য সম্পর্কে বিবৃত করেন, যেখানে তিনি দেখান যে সকল রাশিকে অসীম সংখ্যক অংশে বিভক্ত করা যায়। তিনি এই সূত্রানুসারে বলেন যে, সকল বক্ররেখাকেও অসীম সিরিজে ভাগ করা যায় এবং এর সাহায্যে পদার্থের ক্ষেত্রফল, দৈর্ঘ্য, আয়তন ও এর পৃষ্ঠতল পরিমাপ করা যায়। এই চিঠিতে নিউটন ফ্লাক্সিওন সম্পর্কে কিছুই লিখেননি। যেহেতু তিনি এই সম্পর্কে কোনো কিছুই জানাননি চিঠিতে, কাজেই গাণিতিক ধারা সম্পর্কে তাঁর কাজ এবং লিবনিজ তাঁর নিজের কাজের মধ্যে তেমন কোনো মিল পেলেন না। তিনি নিউটনকে চিঠি লিখলেন এই সম্পর্কে।
এই প্রতিউত্তরে লিবনিজ ধারা সম্পর্কে তাঁর কৃত কাজের বর্ণনা দিলেন এবং প্রথম চিঠিতে নিউটন আসলে ঠিক কোন বিষয়ে মতামত দিয়েছেন, সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে জানাতে বললেন। নিউটন এই চিঠির প্রতিউত্তরে জানালেন যে, তিনি ট্যানজেন্ট অংকনের একটি সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করেছেন এবং ম্যাক্সিমা-মিনিমা নির্ণয় করারও পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। গবেষণার বাকি বিষয়ে তিনি জানাতে চান না।
লিবনিজের ব্যক্তিগত নোটে দেখা যায় যে তিনি ইন্টিগ্রেশনে জন্য বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করেন, যা এখনো ব্যবহার হচ্ছে
১৭১৫ সালে, লিবনিজের মৃত্যুর প্রায় বছরখানেক আগে, লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি স্যার আইজ্যাক নিউটনকে ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক হিসেবে ঘোষণা করে। এটাও বলা হয় যে, লিবনিজ নিউটনের কতিপয় চিঠি ও গবেষণার প্রেক্ষিতে ক্যালকুলাস নিয়ে গবেষণা করেন। এর বেশ কয়েক বছর পরে লিবনিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় রয়্যাল সোসাইটি নিউটন ও লিবনিজ উভয়কেই ক্যালকুলাসের স্বতন্ত্র আবিষ্কারক হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু তখন লিবনিজ আর জীবিত নেই।
প্রকৃতপক্ষে লিবনিজের মৃত্যুর পরও এই নিয়ে অনেক বিতর্ক তখনো থেকে গিয়েছিলো। এমনকি নিউটন এবং তাঁর অনুসারীরা লন্ডনের কূটনৈতিক পৌরসভায় তাঁর গবেষণার পাণ্ডুলিপি ও লিবনিজের কাছে পাঠানো চিঠি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রস্তাব দেন। লিবনিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি ছিলো এই যে, তিনি ক্যালকুলাসে বিকল্প চিহ্নের ব্যবহার করেন। তিনি সমাকলনের জন্য S এর বর্ধিত রূপ এবং ব্যবকলনের জন্য d চিহ্নের ব্যবহার করেন, যা এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে।
অন্যদিকে জোহান বার্নোলি আবার লিবনিজের পক্ষ নিয়ে নিউটনের কাজের সমালোচনা করেন এবং বলেন যে নিউটন লিবনিজের গবেষণার ধারণা চুরি করেছেন। তিনি একটি প্রতিযোগিতামূলক সমস্যার অবতারণা করেন যা ব্র্যাকিস্টোক্রোন প্রব্লেম নামে পরিচিত। এই সমস্যা তিনি প্রেরণ করেন নিউটনের কাছে। এই সমস্যার উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন লিবনিজ। সেই প্রতিবেদনে তিনি লেখেন যে যারা ‘তাঁদের’ গবেষণার সাথে পরিচিত কেবল তাঁরাই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
এখানে ‘তাঁদের’ শব্দের অবতারণা করার কারণে একটি নতুন চরিত্রের উদয় হয়। সেই চরিত্রটি ছিলো ফ্যাটিও ডি ডুইলার, একজন সুইস গণিতবিদ। ইনি পূর্বে লিবনিজ এবং হাইগেনস এর কয়েকটি কাজে তাঁদের সহযোগী ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি লিবনিজের বিক্ষেপিত আচরণের কারণে নিউটনীয় দলে যোগ দেন। লিবনিজপন্থীরা মনে করেন যে, নিউটন ডুইলারের থেকে লিবনিজের কাজ সম্বন্ধে জেনেছেন। কিন্তু ডুইলার বলেন যে, ক্যালকুলাস সম্বন্ধে নিউটনের কাজ মৌলিক এবং নিউটন লিবনিজের আগেই সেটি আবিষ্কার করেন। এভাবে এই বিতর্ক আসলে জটিল হতে শুরু করে। কারণ একদিকে নিউটনপন্থীরা, অন্যদিকে লিবনিজপন্থীরা। তারা একদল আরেকদলকে দোষারোপ করতে থাকেন।
দুজনের কাজ একই বিষয়ে হলেও কাজের পথ এবং ফলাফল ছিলো আলাদা
এখন গণিতবিদ ও গবেষকদের গবেষণায় দেখা যায় যে, নিউটন তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতির দ্বারা কোনো বক্ররেখার অন্তর্গত ক্ষেত্রফল নির্ণয় করতে পারতেন। তাঁর এই গবেষণার মূলভিত্তি ছিলো গতি (Motion)। তিনি ক্যালকুলাস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন মূলত পদার্থবিজ্ঞানে কাজের লাগানোর জন্য। অন্যদিকে লিবনিজ নিজের গবেষণার ক্ষেত্রে গতিকে ব্যবহার করেননি, বরং ব্যবহার করেছেন যোগ ও বিয়োগের ধারণাকে। তাঁর পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় জ্যামিতির ক্ষেত্রে।
তো শেষপর্যন্ত এতসব দ্বন্দ্ব-বিরোধ-বিতর্কের পর রয়্যাল সোসাইটি নিউটন এবং লিবনিজ উভয়কেই স্বতন্ত্রভাবে ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। যদিও ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সমাজ নিউটনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন এবং তাঁরা প্রায় এক শতক পর্যন্ত নিজেদের আত্মমর্যাদার কারণে লিবনিজের গবেষণা গ্রহণ করেননি। তাঁরা শুধুমাত্র নিউটনের গবেষণাকেই গ্রহণ করেছিলেন এবং লিবনিজের তত্ত্বকে গ্রহণ করেননি। তাঁরা কেবল নিউটনের গবেষণারই চর্চা করতেন। যদিও পরবর্তীতে তাঁরা লিবনিজের কাজকে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু এখনো ক্যালকুলাস কে আবিষ্কার করেছেন, এ নিয়ে নিউটনপন্থী ও লিবনিজপন্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকেই গেছে।