গণিত হচ্ছে বিশ্বের ভাষা। তাই আপনি যত বেশি সমীকরণ জানবেন, তত বেশি মহাজগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন।- নিল ডিগ্রেস টাইসন শুধু মার্কিন এই জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী নন, পৃথিবীর অনেক বিজ্ঞানীই গণিত নিয়ে করে গেছেন এমন অনেক উক্তি। না করেই বা উপায় কী? আসলেই তো আমরা সবাই প্রাত্যহিক জীবনে গণিত ছাড়া অচল। এই যেমন,বিস্তারিত পড়ুন
গণিত হচ্ছে বিশ্বের ভাষা। তাই আপনি যত বেশি সমীকরণ জানবেন, তত বেশি মহাজগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন।- নিল ডিগ্রেস টাইসন
শুধু মার্কিন এই জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী নন, পৃথিবীর অনেক বিজ্ঞানীই গণিত নিয়ে করে গেছেন এমন অনেক উক্তি। না করেই বা উপায় কী? আসলেই তো আমরা সবাই প্রাত্যহিক জীবনে গণিত ছাড়া অচল। এই যেমন, সকালে কখন ঘুম থেকে উঠবেন, সেটাও ঠিক করেন সংখ্যা দিয়ে। ঘুম থেকে উঠে প্রথমে কী কাজ করবেন, দ্বিতীয় কাজ কী হবে; এই ‘প্রথম’, ‘দ্বিতীয়’ও গণিতের অংশ। এই গণিতের ইতিহাস সুবিশাল। তবে আজকের গল্পটা গণিতকে নিয়ে না, গণিতের একটি অংশ নিয়ে; ‘গাণিতিক চিহ্ন’ নামেই তার পরিচয়।
গণিতের চিহ্ন অগণিত; Image Source: IB Community Blog
গণিতের এ অংশের সদস্য সংখ্যা মোটেও কম না। যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ, সমান, বর্গমূল, পাই, বন্ধনী, সমানুপাতিক, ব্যস্তানুপাতিক আরও কত কী! চিহ্নের প্রচলনের অনেক আগেও সে চিহ্নের যে কাজ, তার প্রচলন ছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়াটি কথায় লিখে প্রকাশ করতে সময় ও শ্রম দুটিই বেশি প্রয়োজন হতো। তাই সময় অপচয় রোধের উদ্দেশ্যেই চিহ্নের ব্যবহার শুরু। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ২ ও ৩ এর যোগ করতে আমরা কত সহজেই লিখে ফেলি ‘২ + ৩’। কিন্তু যখন এই যোগ চিহ্নের উৎপত্তি হয়নি, তখন লিখতে হতো, ‘২ এর সাথে ৩ যোগ করো’।
আবার ‘২ + ৩’ এর ফলাফল ৫, যা আমরা সহজেই প্রকাশ করতে পারি ২ + ৩ = ৫ লিখে। কিন্তু যখন পর্যন্ত ‘সমান’ চিহ্নের উৎপত্তি হয়নি, তখন এর পরিবর্তে লিখতে হতো ‘ইজ ইকুয়ালস টু’, যা অপেক্ষাকৃত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল। তাই ওয়েলসের গণিতজ্ঞ রবার্ট রেকর্ড তার বই ‘দ্য ওয়েটস্টোন অব উইট’ লিখতে গিয়ে প্রচলন ঘটালের সমান (=) চিহ্নের। এবার তবে আলাদা আলাদা করে চিহ্নদের গল্প করা যাক।
যোগ
দুই বা ততোধিক সংখ্যাকে একসাথে গণনা করতে যে চিহ্ন ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তা-ই যোগ চিহ্ন। আরও বাড়ানোর নিমিত্তেই যোগ করার প্রক্রিয়া। যোগ শব্দের আগমন ল্যাটিন শব্দ Plus থেকে, যার অর্থ ‘আরও’। ল্যাটিন ‘Et’ থেকে & (And)-এর আগমন। এই ‘and’ এর পরিবর্তেই ‘+’ চিহ্ন ব্যবহার করা শুরু হয়। যতদূর জানা যায়, যোগ চিহ্ন হিসেবে ‘+’ এর ব্যবহার শুরু হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে। নিকোলাস ওরেসমে তার ‘অ্যালগোরিসমাস প্রোপোর্শনাম’-এ প্রথমবার ‘+’ চিহ্ন ব্যবহার করেন বলে জানা যায়। তবে সে সময়েই এটি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে, এমনটা নয়। অনেকেই আরও অন্য অনেক ধরনের প্রতীক ব্যবহার করতেন। যেমন, ইতালিয় গণিতবিদ ‘লুকা প্যাসিওলি’ যোগ বোঝাতে ব্যবহার করতেন ইংরেজি ‘p’ এর উপর একটি ছোট দাগ দিয়ে। ‘+’ চিহ্নের প্রচলন ব্যপকভাবে ঘটে জোহানেস উইডম্যান নামক জার্মান গণিতবিদ তার ‘মার্সেন্টাইল অ্যারিথমেটিক’ বইয়ে এ চিহ্ন ব্যবহার করলে।
লুকা প্যাসিওলির ব্যবহৃত চিহ্ন; Image Credit: Author
বিয়োগ
বাদ দেওয়াকেই বিয়োগ বোঝায়। ‘বিয়োগ’ শব্দের উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘minus’ থেকে, যার অর্থ ‘less’ বা কম। লুকাস প্যাসিওলি যোগের মতো বিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু ‘p’-এর স্থলে ‘m’ ব্যবহার করতেন। তবে বিয়োগ চিহ্ন হিসেবে ‘–‘ এর ব্যবহার ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে, তা স্পষ্ট জানা যায় না। খুব সম্ভবত চতুর্দশ শতাব্দীতেই যোগের সাথে বিয়োগেরও উৎপত্তি। বিয়োগ ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে ‘মার্সেন্টাইল অ্যারিথমেটিক’ বইয়ে এর ব্যবহারের পরেই। উল্লেখ্য, ইংরেজদের কাছে যোগ এবং বিয়োগ চিহ্ন প্রথম তুলে ধরেন রবার্ট রেকর্ড’ তার বই ‘দ্য ওয়েটস্টোন অব উইট’-এ ব্যবহারের মাধ্যমে।
এখন শুধু +, – চিহ্ন ব্যবহৃত হয়; Source: Walls Haven
গুন
(×) কিংবা (.); বর্তমান সময়ে গুন বোঝাতে এই দুটি চিহ্নই বহুল ব্যবহৃত। যদিও দ্বিতীয়টির ডট প্রোডাক্ট হিসেবে আলাদা ব্যবহার আছে, তবে প্রথমটিই অধিক ব্যবহৃত হয় সাধারণ গুন বুঝাতে। এ চিহ্নের ব্যবহার শুরু হয় ষোড়শ শতাব্দীতে। বলা হয়ে থাকে, ইংরেজ গণিতবিদ উইলিয়াম অটরেড সর্বপ্রথম এ চিহ্নের ব্যবহার করেন। তবে ঠিক কী কারণে এটির মাধ্যমেই গুন প্রক্রিয়াকে চিহ্নায়িত করা হয়, তা নিশ্চিত নয়। বলা হয়ে থাকে, তিনি সেন্ট এন্ড্রু ক্রস থেকে এর ব্যবহার করেন।
আবার অনেকেরই ধারণা, যেহেতু গুন মূলত অনেক বড় যোগ প্রক্রিয়াকেই সহজতর করেছে, তাই যোগ চিহ্নকেই আড়াআড়িভাবে ব্যবহার করে গুন চিহ্নের ব্যবহার শুরু করা হয়েছে। তবে এটি ইংরেজি ‘x’-এর সাথে মিলে যাওয়ায় জার্মান দার্শনিক ও গণিতবিদ গটফ্রিড এ চিহ্নকে প্রত্যাখ্যান করে শুধু একটি ডট ব্যবহার করেন, যা এখনো অনেকটাই প্রচলিত।
ভাগ
ভাগ চিহ্ন হিসেবে আমরা অনেক চিহ্নের ব্যবহারই দেখে থাকি এই একবিংশ শতাব্দীতেও। এদের মধ্যে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে ‘÷’, ‘/’, ‘x) y (z’ এবং ‘।’; সবশেষে উল্লেখ করা ধরনটির ব্যবহারই হয়তো সবার আগে শুরু হয়েছে, আনুমানিক ত্রয়োদশ শতাব্দীরও আগে। তবে ব্যবহারে ব্যাপকতা লাভ করে ষোড়শ শতাব্দীতে এসে। এটি সামনে আনে আরবীয়রা, এবং পরবর্তী সময়ে ইয়োরোপীয় গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি এটি ব্যবহার করেন ষোড়শ শতাব্দী। ‘/’ চিহ্ন দিয়ে ভাগ বোঝানো শুরু হয় ১৮৪৫ সালে ডি মরগানের হাত ধরে।
তবে বহুল প্রচলিত ভাগ চিহ্ন (÷)-এর ব্যবহার প্রথমবার করেন সুইস গণিতবিদ জোহান রাহন, ১৬৫৯ সালে তার Teutsche Algebra নামক বইতে। যদিও এই চিহ্নটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই বর্তমানে। ভাগ চিহ্ন হিসেবে ‘/’-এর ব্যবহারই বর্তমান সময়ে আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত।
ভাগ চিহ্নের ব্যবহার; Image Source: Teutsche Algebra
সমান
১৫৫৭ সালে ওয়েলসের গণিতবিদ রবার্ট রেকর্ড তার বই ‘দ্য ওয়েটস্টোন অব উইট’ লিখেছিলেন তার ইংরেজ ছাত্রদের জন্য। সে বইয়ে উনি বারবার ‘is equals to’ লিখতে লিখতে বিরক্ত বোধ করার ফলে দু’টি সমান, আনুভূমিক এবং সমান্তরাল দাগ (=) ব্যবহার করেন, যা পরবর্তী সময়ে জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় এবং এখনো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কেউ কেউ তখন দু’টি উল্লম্ব সমান ও সমান্তরাল দাগকেও সমান চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তবে ‘=’ চিহ্নটিই অধিক গ্রহণযোগ্যতা পায়।
রবার্ট রেকর্ডের বই থেকে; Image Source: The Whetstone of Witte
যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ এবং সমান চিহ্নের উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করা আপাতত শেষ, তবে গণিতের চিহ্ন আছে আরও অগণিত। সেসবের কয়েকটি নিয়ে খানিক কথা বলে শেষ করা যাক।
ব্রিটিশ জন ওয়ালিস ১৬৫৫ সালে অসীম বা ইনফিনিটি চিহ্ন প্রথম ব্যবহার করেন। ১৭০৬ সালে পাই চিহ্নের (π) চিহ্নের প্রচলন ঘটান উইলিয়াম জোনস। ১৫২৫ সালে রুডলফ সামনে আনেন স্কোয়ার রুট বা বর্গমূল চিহ্নকে। বীজগণিতের প্রথম জার্মান পাঠ্যবই তারই লেখা। sin, cos, tan এর ব্যবহার শুরু করেন ইউলার, সময়কাল ১৭৪৮ থেকে ১৭৫৩। ১৮০৮ সালে ক্র্যাম্প ফ্যাক্টোরিয়াল চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন ‘!’-কে।
স্কোয়ার রুট বা বর্গমূল চিহ্ন; Image Source: Graphemica
এভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অগণিত মানুষের হাত ধরে বিবর্তিত হয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে এসকল গাণিতিক চিহ্ন। এসব চিহ্ন আমাদের জীবনযাত্রাকে করেছে সহজতর। আর বিশ্বব্যাপী এখনো একই চিহ্নকে আদর্শ হিসেবে ব্যবহার করতে কাজ করে যাচ্ছে আইএসও বা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অভ স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন।
গণিতকে বলা হয় বিজ্ঞানের ভাষা। আমরা ভাষা বলতে যা বুঝি, গণিত কি তেমনই বাংলা, ইংরেজি কিংবা ম্যান্দারিনের মতো কোনো ভাষা? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের দেখতে হবে গণিতের শব্দ ও ব্যাকরণ কীভাবে এক একটি বাক্য রচনা করে। ভাষা কী? ভাষার বহুরকম সংজ্ঞায়ন হতে পারে। ভাষা হতে পারে কিছু শব্দ বা সংকেত, যেগুলো কিছুবিস্তারিত পড়ুন
গণিতকে বলা হয় বিজ্ঞানের ভাষা। আমরা ভাষা বলতে যা বুঝি, গণিত কি তেমনই বাংলা, ইংরেজি কিংবা ম্যান্দারিনের মতো কোনো ভাষা? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের দেখতে হবে গণিতের শব্দ ও ব্যাকরণ কীভাবে এক একটি বাক্য রচনা করে।
ভাষা কী?
ভাষার বহুরকম সংজ্ঞায়ন হতে পারে। ভাষা হতে পারে কিছু শব্দ বা সংকেত, যেগুলো কিছু নিয়মের অধীনে থাকে। আবার বলা যেতে পারে, শব্দ কিংবা প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে যোগাযোগের একটি পদ্ধতি। বিশ্ববিখ্যাত ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি ভাষাকে সংজ্ঞায়ন করেন সসীম সংখ্যক উপাদান দিয়ে গঠিত বাক্যসমগ্র বলে।
যেভাবেই সংজ্ঞায়ন করা হোক, আমরা সার্বিক বিবেচনায় কিছু উপাদানকে ভাষার বৈশিষ্ট্যের সূচক বলে ধরতে পারি।
ভাষা চর্চিত হবে একদল মানুষের মাঝে, আর ভাষাটি তাদের পারস্পরিক বোধ্যগম্যও হতে হবে; Source: Journal of Speech, Language, and Hearing Research – ASHA
এই শর্তগুলো হাতে নিয়ে গণিতের দিকে তাকালে দেখা যায়, গণিত সবগুলো শর্তই পূরণ করে বসে আছে। বিশ্বব্যাপী গণিতের প্রতীক, তার অর্থ, ব্যবহার আর ব্যাকরণ একই। গণিতবিদ, বিজ্ঞানী এবং অন্যান্যরা ধারণার আদান-প্রদানে গণিতকে ব্যবহার করেন। গণিত যেমন একদিকে বাস্তব ঘটনাকে বর্ণনা করতে পারে, তেমনই বিমূর্ত ধারণাকেও বর্ণনা করতে পারে। এমনকি গণিতের এমন একটি শাখা আছে, যেখানে নিজেই নিজেকে বর্ণনা করতে পারে। ঐ শাখাটি হলো মেটা-ম্যাথমেটিকস।
অভিধান, ব্যাকরণ ও পদবিন্যাস
গণিতের অভিধান সাজানো হয়েছে বিভিন্ন বর্ণমালা থেকে। পাশাপাশি এতে আছে বিভিন্ন চিহ্ন, যেমন যোগ কিংবা বিয়োগ। একটি গাণিতিক সমীকরণকে বলা যায় শব্দের সমাহারে তৈরি বাক্য। একটি সরল গাণিতিক সমীকরণ বিবেচনা করি।
3 + 5 = 8
একে পড়া যায়- তিন এর সাথে পাঁচ যোগ করলে আট এর সমান হয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি পরিপূর্ণ বাক্য।
গণিতের ভাষায় বিশেষ্য পদ হলো এগুলো
সংখ্যা ও অংক (0, 2, 5, 9, 17 ইত্যাদি)
ভগ্নাংশ (1⁄4, 5⁄9, 2 1⁄3)
চলক (a, b, c, x, y, z ইত্যাদি)
রাশি (3x, x^2, 4+x ইত্যাদি)
রেখাচিত্র বা দৃশ্যমান উপাদান (বৃত্ত, কোণ, ত্রিভুজ, টেন্সর, ম্যাট্রিক্স ইত্যাদি)
অসীম সংখ্যা (∞)
পাই (π)
কাল্পনিক সংখ্যা (i, -i)
আলোর বেগ (C)
গণিতে ব্যবহৃত প্রতীক দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে বাক্য; Source: Westend61 / Getty Images
গণিতের ক্রিয়াপদগুলো
সমান ও অসমতা চিহ্ন (=, <, >)
গাণিতিক ক্রিয়া, যেমন- যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, বর্গমূল করা। (+, , ×, ÷)
অন্যান্য ক্রিয়া (sin, cos, tan, sec ইত্যাদি)
গণিতের ব্যাকরণ এবং বাক্যগঠন অভিধানের মতোই আন্তর্জাতিক। কেউ যে দেশেরই লোক হোক, যে ভাষাতেই কথা বলুক, গাণিতিক ভাষার গঠন সকল দেশে একই। গাণিতিক সার্বজনীনতা সকলের জন্য সমান।
গণিতের রাশিমালা সবসময় লিখতে হয় বাম দিক থেকে; Source: Emilija Manevska
ভাষা একটি শিক্ষা উপকরণ
কীভাবে গাণিতিক বাক্যগুলো কাজ করে তা জানলে গণিত শেখা ও শেখানো উভয় পক্ষের জন্যই কার্যকরী ভূমিকা রাখে। সংখ্যা এবং প্রতীক প্রায়ই শিক্ষার্থীদের আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। তাই কোনো পরিচিত ভাষায় সমীকরণকে বর্ণনা করলে তা সহজে শিক্ষার্থীর কাছে গ্রহণীয় হয়। মূলত, এটা অনেকটা কোনো বিদেশী ভাষাকে নিজের ভাষায় রূপান্তরের মতো।
যেহেতু পৃথিবীব্যাপী গণিত একই, তাই স্বভাবতই গণিত একটি বিশ্বজনীন ভাষা। গণিতের কোনো সংজ্ঞা কিংবা সূত্রের অর্থ বিভিন্ন ভাষায় একই। দুজন মানুষের মধ্যে কথ্য ভাষায় ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু গণিত সেই যোগাযোগ বাধা উৎরে গিয়েও কাজ করতে পারে।
গণিত শুধু সংখ্যা আর সমীকরণ নয়
গণিত বলতে শুরুতেই মোটাদাগে সংখ্যা আর সংখ্যাদের দিয়ে কিছু ক্রিয়া (যেমন, যোগ, বিয়োগ, ভাগ, বর্গমূল ইত্যাদি) বোঝায় না। বিমূর্ততা, ভাবমূলক বর্ণনা, বস্তুনিরপেক্ষ সংজ্ঞায়ন গণিতের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। জ্যামিতির কথাই বিবেচনা করি। একটি বস্তু কেমন হতে পারে তা গণিতের আওতাধীন। এমনকি কোনো বস্তু কেমন হওয়া অসম্ভব তা-ও গণিত শাস্ত্রের আওতাধীন।
সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে, মানুষের দ্বারা যত ভাষা সৃষ্টি হয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে আদিম কিন্তু এই গণিতই। যুক্তি ও যাচাইয়ের ভিত্তি হিসেবে সবসময় কাজ করেছে এই গণিত। ধর্ম, সংস্কৃতি, লিঙ্গ, কাল ইত্যাদি কোনোকিছুই এ ধারণার পরিবর্তন করতে পারেনি।
গণিতকে ভাষা না বলার যুক্তি
গণিতকে ভাষা বলার যুক্তি যেমন আছে, তেমনই একে নিয়ে আছে বিপরীত মত কিংবা ভিন্ন মত। অনেক ভাষাবিদ একে ভাষা হিসেবে স্বীকার করতে নারাজ। কারণ ‘ভাষা’র কোনো কোনো সংজ্ঞায় যোগাযোগকে কথ্যরূপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। গণিত মূলত যোগাযোগের একটি লিখিত মাধ্যম; যেখানে খুব সরল একটি সমীকরণ সহজেই পড়ে ফেলা সম্ভব (যেমন- 1 + 1 = 2), কিন্তু জটিল কোনো সমীকরণ যেমন, ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ পড়তে গেলে বক্তার মাতৃভাষার সহায়তা নিতেই হবে- যে কারণে গণিত তাদের মতে ভাষা হিসেবে বিশ্বজনীনতা হারায়।
একই যুক্তিতে ইশারা বা সাংকেতিক ভাষার (Sign language) স্বীকৃতিও কেড়ে নেয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশ ভাষাতাত্ত্বিকেরা সাংকেতিক ভাষাকে সত্যিকার ভাষা হিসেবে স্বীকার করেন।
ভাষা মাত্রই ভাবের আদান প্রদান জরুরী; Source: Dictaview.com
গণিত দিয়ে আমরা বিশাল মহাবিশ্বের বিবিধ রহস্য থেকে শুরু করে কোষের ক্ষুদ্র জটিল জগত এমনকি ডিএনএ পর্যন্ত ব্যাখ্যা করতে পারি। শুধু তা-ই নয়, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুকেও ব্যাখ্যা করতে পারি। গ্রহদের গতি, জটিল রোগের প্রতিকার এমনকি ঘরের দরজা থেকে বেরিয়ে কর্মস্থল বা শিক্ষাঙ্গন, পার্ক যেখানেই যাই না কেন গণিতের অস্তিত্বকে ঝেড়ে ফেলার কোনো উপায় নেই। কম্পিউটার আর তথ্য বিনিময়ের অতিকায় বিপ্লবের বিস্তারিত কথা না-ই বললাম।
দৈনন্দিন জীবনে গণিত আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে আমরা তার খানিকটাও দেখতে পাই না। অনেকটা বাতাসের সমুদ্রে থেকে বাতাসকে না দেখার মতো। আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির কারণে আমরা হয়তো অভ্যাসের ভেতর থেকে ছেঁকে এনে ততটা খেয়াল করি না গণিতকে, কিন্তু যদি বলা হয় শুধুমাত্র সংখ্যা ছাড়া একটা দিন চলতে, তাহলে কি কেউ পারবে?
আধুনিক পৃথিবীর কোনো কল্পনায় আপনাকে নাহয় না ভাসালাম। আদিম সমাজের গুহাবাসী কোনো পরিবারের কর্তাকে যদি কেউ বলতো, তোমার কয় ছেলেমেয়ে গো?
কর্তাকে ছেলেমেয়েদের বের করে এনে দেখাতে হতো এই যে এরা! সংখ্যা না থাকলে এছাড়া আর কী উপায় আছে বলার? কর্তা যদি প্রতিকী দাগ দিয়ে, পাথর কিংবা কাঠি দিয়েও ছেলেমেয়ের সংখ্যা বোঝাতে যায় তাহলেও কিন্তু বিপদ! গণিত ঢুকে যাবে এতে!
আমাদের সকল ক্ষেত্রে আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে বিজড়িত একটি বিষয়কে ভাষা না বললেও, এর গুরুত্ব ভাষার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
সংক্ষেপে দেখুন