হোমপেজ/ড্রাগন
সাইন আপ করুন
লগিন করুন
পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? আপনার ইমেইল এড্রেস দিন। ইমেইলের মাধ্যমে আপনি নতুন পাসওয়ার্ড তৈরির লিংক পেয়ে যাবেন।
আপনি কেন মনে করছেন এই প্রশ্নটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই উত্তরটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই ব্যক্তিকে রিপোর্ট করা উচিৎ?
রাগত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক উড়ছে আর ক্ষণে ক্ষণে মুখ থেকে আগুনের হলকা বের করছে- ড্রাগনকে তো এই রূপেই চিনি আমরা। যুগে যুগে ড্রাগন নিয়ে কম মিথের সৃষ্টি হয়নি, যদিও আদৌ তাদের অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্কেরও কোনো কমতি নেই। একদিকে পৃথিবীর বুকে তাদের বিচরণের ইতিহাস প্রমাণের জন্য আজও নিরলসভাবে খেটে চলেছেন ইতিবিস্তারিত পড়ুন
রাগত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক উড়ছে আর ক্ষণে ক্ষণে মুখ থেকে আগুনের হলকা বের করছে- ড্রাগনকে তো এই রূপেই চিনি আমরা। যুগে যুগে ড্রাগন নিয়ে কম মিথের সৃষ্টি হয়নি, যদিও আদৌ তাদের অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্কেরও কোনো কমতি নেই। একদিকে পৃথিবীর বুকে তাদের বিচরণের ইতিহাস প্রমাণের জন্য আজও নিরলসভাবে খেটে চলেছেন ইতিহাসবেত্তারা, অপরদিকে নিত্যনতুন মুখরোচক সব গল্পের ঝুলি ভর্তি হচ্ছে মানুষের মুখে মুখে। সে যা-ই হোক, ড্রাগনের কথা আমরা সাধারণত চীন, জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া কিংবা ইন্দোনেশিয়ার উপকথায় পেয়ে থাকলেও মজার বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের বগা লেককে ঘিরেই রয়েছে একটি ড্রাগন মিথ। চলুন তবে জেনে আসা যাক বান্দরবানের বগা লেকের সাথে ড্রাগনের সম্পর্কটা আসলে কোথায়?
সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি বান্দরবান আর সেখানকার প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি বগা লেক, দ্য লেক অফ মিস্ট্রি বা ড্রাগন লেক নামেও সুপরিচিত এটি। যুগে যুগে অভিযাত্রিকদের তা আকৃষ্ট করেছে দুর্নিবারভাবে। বগা লেকের আসল নাম ‘বগাকাইন হ্রদ’, যা স্থানীয়ভাবে ‘বগা লেক’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার স্বাদু পানির একটি হ্রদ এটি। কেওক্রাডং পর্বতের গা ঘেঁষে, বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে বগা লেকের অবস্থান। প্রশাসনিক হিসেবে হ্রদটি রুমা উপজেলায় পড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৪০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লেকটি। ফানেল বা চোঙাকৃতির আরেকটি ছোট পাহাড়ের চুড়ায় বগা লেকের অদ্ভুত গঠন অনেকটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের কথা মনে করিয়ে দেয়।
হতে পারে এই সেই বগা!
আজ থেকে প্রায় ২,০০০ বছর আগে উৎপত্তি হয় বগা লেকের। এর উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত আছে বেশ কিছু মিথ। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত গল্পটি অনেকটা এরকম।
অনেক অনেক দিন আগে বান্দরবানে একটি চোঙাকৃতির পাহাড় ছিল। তখনকার বান্দরবান আর এখনকার বান্দরবানের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক বিদ্যমান। সে সময় বান্দরবান মানেই ছিল দুর্গম পাহাড়ে ঘেরা ঘন অরণ্যের বসতি। সে পাহাড়ের আদিম কোলে বাস করত আদিবাসীর দল। ম্রো, বম, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা সহ আরও বেশ কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের আবাস ছিল সেথায়। হঠাৎ করে সেসব গ্রাম থেকে হারিয়ে যেতে থাকে গবাদিপশু থেকে শুরু করে ছোট ছোট বাচ্চারাও।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে গ্রামপ্রধান, সাধারণ মানুষ সবাই। খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেল, বাচ্চাগুলোর কিংবা গবাদিপশুর সর্বশেষ পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে ঐ চোঙা আকৃতির পাহাড়ে। সবাই ধারণা করতে শুরু করলো, অতিপ্রাকৃত কিছু একটি বাসা বেঁধেছে রহস্যময় ঐ পাহাড়ের কোলে, তারই আক্রমণের শিকার হচ্ছে নিরীহ এই প্রাণী আর বাচ্চারা। আসল রহস্য উদঘাটন করতে এগিয়ে আসে গ্রামের একদল সাহসী পুরুষ। তারা চোঙা আকৃতির পাহাড়ের মাথায় উঠে দেখে, সেখানে বসে আছে বিশাল এক ড্রাগন। তাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না এই ড্রাগনের খপ্পরেই পড়েছে এতোগুলো প্রাণী!
ড্রাগনের উপস্থিতি নিয়ে অবশ্য ভিন্ন একটি মত প্রচলিত আছে। সেই মতানুসারে, বর্তমানে যেখানে বগা লেক অবস্থিত, সেখানে একদিন আকাশ থেকে নেমে আসে আজব এক প্রাণী। এমন কোনো প্রাণী যে পৃথিবীতে থাকতে পারে, স্থানীয়রা তা কল্পনাও করতে পারেনি। বিশাল পাখাওয়ালা সেই প্রাণী যখন-তখন আগুনের হলকা বের করে ধ্বংস করে দিতে থাকে তাদের ঘরবাড়ি। প্রচণ্ড ঘাবড়ে যায় তারা। কী করে এই উদ্ভট জীবটিকে খুশি করা যাবে, সে উপায় খুঁজতে থাকে গ্রামবাসী। ইতোমধ্যে ড্রাগনটি চোঙা আকৃতির ঐ গুহায় নিজের আস্তানা বানিয়ে নেয়। এলাকার লোকজন তার নাম দেয় ‘বগা’। বগাকে খুশি করতে নিয়মিত বিভিন্ন জীবজন্তু ধরে নিয়ে উপঢৌকন হিসেবে পরিবেশন করতে থাকে তারা। বেশ নিরুপদ্রবভাবেই দিন কাটতে থাকে সবার।
এমনই কোনো এক আগুনের হলকায় হয়তো সৃষ্টি হয় বগা লেক
এর মধ্যে হঠাৎ করে গ্রামের শিশুরা নিখোঁজ হতে থাকে একের পর এক। শুরুতে এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়কে দোষারোপ করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তারা টের পায়, এটি কোনো নির্দিষ্ট গোত্রের সাথে নয়, বরং সবার সাথেই ঘটছে। এবার সবার সন্দেহের তীর এসে পড়ে বগার দিকে। বগাকে উৎখাত করতে না পারলে বাঁচানো যাবে না শিশুদের, এটুকু বুঝতে কারো বাকি থাকে না। কাজেই প্রতিটি গোত্র থেকে বেছে বেছে সাহসী জওয়ানদের নিয়ে গঠন করা হলো একটা দল। যুদ্ধ করেই হোক আর নিজের জীবন বাজি ধরে ড্রাগনের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েই হোক- শিশুদের তারা উদ্ধার করে আনবেই এই ব্রত নিয়ে বেরিয়ে গেল যোদ্ধারা।
তীর, ধনুক, বল্লম, লাঠি আর মশাল হাতে নিয়ে রাতের অন্ধকারে তারা হানা দিল বগার গুহায়। গুহার মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষের রক্ত আর হাড়গোড় দেখে তারা বুঝে নিল কী ঘটেছে এখানে। ক্ষেপে গিয়ে একসঙ্গে ঘুমন্ত বগার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল যুবকরা। কোনো জাদুবিদ্যা দেখানো বা আগুনের ফোয়ারা ছোটানোর আগেই বগাকে কুপোকাত করে ফেললো সবাই মিলে। এতজন যোদ্ধার সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে কোনোমতে গা ঝাড়া দিয়ে পালানোর রাস্তা খুঁজতে লাগলো সে। যে রথে করে একদিন তার উদয় হয় বগা লেকের পাড়ে, সেই রথে উঠে পালানোর চেষ্টা করল বগা। কিন্তু গ্রামের ক্ষিপ্ত যুবকরা বগার রথে আগুন ধরিয়ে দিল।
যোদ্ধাদের ধরিয়ে দেয়া সে আগুনে পুড়ে মরল বগা। তবে তার আগে শেষবারের মতো মুখ থেকে আগুনের ফোয়ারা ছুটাল সে। সেই আগুনের তাপে আর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে থর থর করে কেঁপে উঠল চোঙা আকৃতির পাহাড় আর বগার তৈরি করা গুহা। ভেঙে পড়তে শুরু করলো পাহাড়, তৈরি হলো বিশাল এক গর্ত। এই গর্তটিই বর্তমানে বগা লেক হিসেবে পরিচিত, যার অপর নাম ড্রাগন হ্রদ।
কে বলবে শান্ত এই নিরিবিলি হ্রদে এক সময় ড্রাগন ছিল?
এ ব্যাপারে তৃতীয় যে মতটি প্রচলিত রয়েছে, তা অনেকটা এরকম।
আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে বান্দরবান অঞ্চলে বসবাস করতো খুমী নামক আদিবাসী একটি গোত্র। অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর মতো তাদেরও নিজস্ব কিছু প্রাচীন দেবতা ছিল। আঞ্চলিক উপকথা অনুযায়ী, এই দেবতাদের মধ্যে একজন স্থানীয়দের উপর রেগে গিয়ে নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তিনি একটি ড্রাগনের রূপ ধারণ করেন এবং পূজারীদের ধরে ধরে খাওয়া শুরু করেন। ড্রাগনরূপী সে দেবতা এক পর্যায়ে খুব জোরে হুংকার ছাড়েন, আর তার ফলে একটি অবিশ্বাস্য ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। এই ভূমিকম্পের কারণেই যেখানে গরীব গ্রামবাসীরা বসবাস করত, সেখানে তৈরি হয় একটি হ্রদ। এই হ্রদটিই যে বগা লেক, তা বলাই বাহুল্য! অচিরেই বৃষ্টির পানিতে ভরে ওঠে গর্তটি। এরপর থেকে বাইরের কোনো সাহায্য পাওয়া না গেলেও, এই লেকের পানি কখনো শুকায়নি। প্রতি বসন্তে হ্রদের স্বচ্ছ পানি ঘোলা হয়ে যায় আর রঙ পরিবর্তন করতে থাকে। এই ঘটনা আদিবাসীদের বিশ্বাসকে আরো বদ্ধমূল করে তোলে আর তার সাথে সাথে আরো নানা ধরনের উপকথার জন্ম দেয়।
উৎপত্তিগত দিক থেকে, বগা শব্দটি নেয়া হয়েছে ‘বাগা’ থেকে। বাগা অর্থ রাগান্বিত ড্রাগন। এবার আসা যাক বগা লেকের উৎপত্তি সম্পর্কে ভূতাত্ত্বিকেরা কী বলছেন, সে প্রসঙ্গে। তাদের মতে, হয় মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ নয়তো মহাশূন্য থেকে উল্কাপিণ্ডের পতনের কারণে সৃষ্টি হয়েছে বগা লেক। এর পানি অম্লধর্মী। কোনো জলজ প্রাণীর পক্ষে এখানে বেঁচে থাকা সম্ভব না। বাইরের কোনো পানি এখানে ঢুকতেও পারে না, আবার এর আশপাশে পানির কোনো দৃশ্যমান উৎসও নেই। কাজেই আশেপাশে পানির কোন উৎস না থাকলেও এই বিশাল জলরাশি কীভাবে সৃষ্টি হলো, তা এক রহস্যই বটে। তবে তারচেয়েও বড় রহস্য হচ্ছে বগা লেকের পানির রঙ পরিবর্তন। প্রতি বছর অদ্ভুত কোনো এক কারণে বগা লেকের পানির রঙ কয়েকবার পাল্টায়।
শান্ত-স্নিগ্ধ বগা লেক
অলৌকিক সৌন্দর্যের বগা লেক নিয়ে রয়েছে অজস্র রহস্য। এর আশেপাশে কোনো ঝর্ণা না থাকলেও, লেকের মতোই চারপাশের অন্যান্য জলাশয়ের পানির রঙেও দেখা দেয় একই পরিবর্তন। এর বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, লেকটির তলদেশে একটি উষ্ণ ঝর্ণা রয়েছে। ঝর্ণা থেকে যখন পানি বের হয়, তখনই হ্রদের পানির রঙ বদলে যায়। আবার পাহাড়িদের মধ্যে প্রচলিত ড্রাগন বা আগুনের মিথ অনুযায়ী অনেকেই একে মৃত আগ্নেয়গিরি বলে সন্দেহ করেন। এই মৃত আগ্নেয়গিরির প্রভাবেও লেকের পানির রঙে পরিবর্তন আসতে পারে। ঝর্ণা বা লেক কোনোটার গভীরতাই এখনো পর্যন্ত নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। স্থানীয়দের মতে গভীরতা ২০০-২৫০ ফুট হলেও ইকো মিটারে ১৫১ ফুট পর্যন্ত গভীরতার হদিস পাওয়া গেছে।
অনেকেই ভাবতে পারেন এগুলো নিছকই গল্প। তবে যাহা রটে তাহার কিছু তো বটে! কাপ্তাই হ্রদ, মহামায়া হ্রদ, ফয়েজ লেক আরও কত হ্রদ তো আছে, কোনোটি নিয়েই তো এমন কাহিনীর প্রচলন নেই। সত্যিটা জানার তো আর কোনো উপায় নেই, আপাতত নাহয় বহুল প্রচলিত এই মিথগুলোই জানা থাকুক আমাদের সবার।
সংক্ষেপে দেখুন