হোমপেজ/মনমাতানো গন্ধের উৎস
সাইন আপ করুন
লগিন করুন
পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? আপনার ইমেইল এড্রেস দিন। ইমেইলের মাধ্যমে আপনি নতুন পাসওয়ার্ড তৈরির লিংক পেয়ে যাবেন।
আপনি কেন মনে করছেন এই প্রশ্নটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই উত্তরটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই ব্যক্তিকে রিপোর্ট করা উচিৎ?
“তখনও এই রকম কালবৈশাখী নামবে, এই রকম মেঘান্ধকার আকাশ নিয়ে, ভিজে মাটির গন্ধ নিয়ে, ঝড় নিয়ে, বৃষ্টির শীকরসিক্ত ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া নিয়ে, তীক্ষ্ম বিদ্যুৎ চমক নিয়ে-তিন হাজার বছর পরের বৈশাখ-অপরাহ্নের উপর । তখন কি কেউ ভাববে তিন হাজার বৎসর পূর্বের প্রাচীন যুগের এক বিস্মৃতি কালবৈশাখীর সন্ধ্যায় এক বিস্মবিস্তারিত পড়ুন
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “অপ্রকাশিত দিনলিপি” থেকে নেওয়া কথাগুলো পড়তে পড়তে গ্রামের সদ্য বৃষ্টিতে ভেজা মাটির অন্যরকম গন্ধটা বুক ভরে নিতে ইচ্ছে করছে না? হ্যাঁ! প্রকৃতপক্ষে আমরা প্রায় সবাই বৃষ্টির এই দারুণ গন্ধকে ভীষণ পছন্দ করি। কিন্তু কখনও ভেবেছেন কি, এই ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের উৎস কোথায় আর কীভাবেই বা এই গন্ধের সৃষ্টি হয়? চলুন আজ সেই কথাই জেনে নেই।
বৃষ্টিতে ভেজা মাটির গন্ধের খুব সুন্দর একটি ইংরেজি শব্দ রয়েছে। ইংরেজিতে এই গন্ধটিকে ডাকা হয় পেট্রিকোর (Petrichor) নামে। বৃষ্টির ফোঁটা যখন শুকনো মাটিতে পড়ে, তখন এই পেট্রিকোরের সৃষ্টি হয়। পেট্রিকোর কথাটি এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে, যার আভিধানিক অর্থ পাথরের শোণিতধারা (The blood of stones)।
অস্ট্রেলিয়ান কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (CSIRO) এর দুই বিজ্ঞানী ইসাবেল জয় বিয়ার এবং রিচার্ড থমাস এই শব্দটি প্রথম প্রস্তাব করেন। ১৯৬৪ সালে নেচারে প্রকাশিত তাদের গবেষণা প্রবন্ধে তারা এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। সাধারণত বৃষ্টির আগে শুকনো মাটি বিভিন্ন উদ্ভিদ থেকে একধরনের তেল পরিশোষণ করে থাকে। এই দুই গবেষক সেই পরিশোষিত তেলকে আবার সংশ্লেষ করতে সক্ষম হন। তারা দেখান, যখন বৃষ্টি হয়, তখন এই পরিশোষিত তেল জিওস্মিন নামে আরেক ধরনের যৌগের সাথে মিশ্রিত হয়ে বায়ুতে ব্যাপিত হয়। মূলত এই দুই যৌগের বায়ুতে ব্যাপনের ফলেই বৃষ্টিতে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের সৃষ্টি হয়।
বাঁয়ে বিজ্ঞানী রিচার্ড থমাস, ডানে বিজ্ঞানী ইসাবেল জয় বিয়ার;
শুকনো মাটি উদ্ভিদ থেকে যে তেল পরিশোষণ করে থাকে, সেই তেলে মূলত মিশে থাকে পামিটিক এসিড, স্টিয়ারিক এসিড এবং আরও নানা প্রকার রাসায়নিক পদার্থ, যার সবগুলোকে বিজ্ঞানীরা এখনো নির্দিষ্ট করতে পারেননি। তবে মাটিতে মিশে থাকা পামিটিক এসিড ও স্টিয়ারিক এসিডের এই বৃহৎ অণু বৃষ্টির সময় বিশ্লিষ্ট হয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র অণু, যেমন- কিটোন, অ্যালডিহাইড প্রভৃতি উৎপন্ন হয়।
পামিটিক এসিড ও স্টিয়ারিক এসিডের বৃহৎ অণু;
অন্যদিকে জিওস্মিন পদার্থটি মাটিতে বাস করতে থাকা এক্টিনোব্যাক্টেরিয়া পর্বভুক্ত অণুজীবদের দ্বারা সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ধরনের সায়ানোব্যাক্টেরিয়া এবং স্ট্রেপ্টোমাইসিস গণের ব্যাকটেরিয়ার মৃত কোষ থেকে মূলত জিওস্মিন সৃষ্টি হয়। ২০০৬ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথম স্ট্রেপটোমাইসিস কোয়েলিকালার (Streptomyces coelicolor) ব্যাকটেরিয়ায় থাকা উৎসেচক থেকে জিওস্মিনের জৈব সংশ্লেষের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারেন।
Actinobacteri
ফার্নেসাইল ডাইফসফেট থেকে দুই ধাপে সম্পন্ন হওয়া একটি বিক্রিয়ার মাধ্যমে জিওস্মিন সিন্থেজ নামর একটি উৎসেচকের প্রভাবে জিওস্মিন উৎপাদিত হয়।
জিওস্মিন উৎপাদী বিক্রিয়া
ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের পেছনের জীববৈজ্ঞানিক কারণ তো জানা গেল। কিন্তু এরপর বিজ্ঞানীরা চিন্তা করতে লাগলেন, এই গন্ধ আমাদের নাকে এসে পৌঁছায় কী করে। অর্থাৎ এর পেছনে থাকা পদার্থবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা ঠিক কীরূপ?
তাই এই গন্ধের উৎস এবং প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আরও জানতে ২০১৫ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির একদল গবেষক ১৮ ধরনের মাটির সংস্পর্শে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে দিয়ে প্রায় ৬০০টি পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। এই ভিডিওটিতে পরীক্ষাটির বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
খালি চোখে না দেখা গেলেও আমরা সকলেই জানি, যেকোনো মাটির সমতল থাকে অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত। বৃষ্টির ফোঁটা যখন এই মাটির তলে এসে পড়ে, তখন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছিদ্রে আটকে থাকা বাতাস থেকে বুদবুদের সৃষ্টি হয়। এই বুদবুদ যখন মাটির সমতল থেকে বায়ুর সংস্পর্শে এসে ফেটে যায়, তখন এই বুদবুদে আটকে থাকা বিভিন্ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রাসায়নিক অণু বাতাসে মিশে এই সোঁদা গন্ধের জন্ম দেয়।
বিজ্ঞানীদের উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ক্যামেরায় ধরা পড়া ছিদ্রযুক্ত তল থেকে উৎপন্ন হওয়া বুদবুদের বাতাসে মেশার দৃশ্য ( বাতাসের সংস্পর্শে মিশে যেতে থাকা দুটি বুদবুদকে লাল বৃত্ত দ্বারা চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে)
শুধু জিওস্মিন কিংবা উদ্ভিজ তেলকণা নয়, মাটিতে থাকা অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস কিংবা অন্যান্য রাসায়নিক অণুও এই বুদবুদে মিশে থাকতে পারে। যত ধীরে বৃষ্টিকণা মাটিতে পড়ে, তত বেশি বুদবুদ বাতাসে মিশে যাওয়ার সুযোগ পায়। আর তাই খুব হালকা এক পশলা বৃষ্টির পরে ভেজা মাটির গন্ধ অপেক্ষাকৃত তীব্রতর বলে মনে হয়।
আমাদের নাসারন্ধ্রে থাকা ঘ্রাণ সংবেদকগুলো জিওস্মিনের গন্ধের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল। তাই বাতাসে এর পরিমাণ প্রতি ট্রিলিয়নে ৫ ভাগ, অর্থাৎ প্রতি কেজি বাতাসে মাত্র ৫ ন্যানোগ্রাম (৫ × ১০-৯ গ্রাম) থাকলেই মানুষের নাক তা শনাক্ত করতে পারে। এই সোঁদা গন্ধকে কাজে লাগিয়ে নানা সুগন্ধি তৈরি করার সম্ভাবনা নিয়েও তাই মানুষ অনেক সময় চিন্তা করেছে। স্বাধীনতার বেশ কিছু আগে ভারতীয় উপমহাদেশের নানা স্থানে দেশীয় সুগন্ধি দ্রব্য তৈরির শিল্প গড়ে উঠেছিল। শ্রমিকেরা গরমকালে মাটি শুকিয়ে তারপর বর্ষার আগে বাষ্প-পাতন করে সেই বাষ্প চন্দনের তেলে মিশিয়ে নিত। তারপর সেই তেল বিক্রি করতো বাজারে। উত্তর প্রদেশে এর জনপ্রিয় নাম ছিল মিট্টি আতর। এই মিট্টি আতর এখনও বেশ জনপ্রিয় এবং বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত বিক্রি হয়।
মিট্টি আতর; Source: kazima perfume
শুধু মাটির সোঁদা গন্ধ নয়, জলের স্যাঁতস্যাঁতে ভাব কিংবা মাটির নিচে হওয়া সবজিগুলোর মেটে স্বাদও এই জিওস্মিনের জন্যই হয়ে থাকে। জিওস্মিনের এমন নানা ধরনের উপকারী দিকের পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন- মাটির বিভিন্ন স্তরের ব্যাকটেরিয়ার মৃত কোষ থেকে যেহেতু এই গন্ধের সৃষ্টি হয়, সেহেতু অনেক সময় কোনো স্থানে নলকূপ খননের পর সেই স্থানের পানীয় জলে এই ঘ্রাণ মিশে থাকে। এতে ঐ স্থানের পানি সুপেয় হয় না। অবশ্য বিজ্ঞানীরা এই ঘ্রাণকে কীভাবে দূর করা যায় সেই বিষয়েও বিস্তারিত গবেষণা করছেন।
সোঁদা মাটির গন্ধের পেছনের বিজ্ঞান সম্বন্ধে জানলেন তো? এরপর থেকে যখন বৃষ্টি দেখে রোমান্টিকতায় আক্রান্ত হবেন আর ভেজা গন্ধে নস্টালজিয়া অনুভব করবেন, অবশ্যই সেই কাব্যময়তার মধ্যেও বিজ্ঞানের সৌন্দর্যের কথা স্মরণে রাখতে একদম ভুলবেন না যেন!