চুম্বন’ আদর ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ কতটা সত্যি ?
শেয়ার করুন
সাইন আপ করুন
লগিন করুন
পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? আপনার ইমেইল এড্রেস দিন। ইমেইলের মাধ্যমে আপনি নতুন পাসওয়ার্ড তৈরির লিংক পেয়ে যাবেন।
আপনি কেন মনে করছেন এই প্রশ্নটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই উত্তরটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই ব্যক্তিকে রিপোর্ট করা উচিৎ?
ফাইল ছবি
চুম্বন মানেই যে শুধু তা কোনো প্রেমিক যুগলের মধ্যে ঘটবে তা নয়। চুমু মানে আদরের স্পর্শ ও ভালোবাসার এক বহিঃপ্রকাশ।
মা-বাবা ছেলেমেয়েকে চুমু দেয়, ছেলেমেয়ে বাবা-মাকে। বড়রা ছোটদের চুমু দেয়, ছোটরা বড়দের। ভালবাসার এক নরম উচ্ছ্বাসের ছোঁয়া থাকে সেই চুমুতে।
চুমুর রকমফেরও রয়েছে হাজার গন্ডা। চুমুকে নানা প্রথা ও সম্মান জানানোর জন্যও ব্যবহার করা হয়। খ্রিস্টানরা পোপের হাঁটুতে চুমু খায়, বিশপেরা আংটিতে চুমু খান, ফাদাররা চুমু খান পবিত্র ক্রসে। জোয়ান অফ আর্ক চুমু খেতেন তার তলোয়ারে।
বিখ্যাত লেখক লানা সিট্রন তার এ কম্পেনডিয়াম অব কিসেস বইতে চুমুর বিশাল ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘এই কর্মটি শুধু ভালোবাসা পেতে বা দিতে নয়, বরং আজও অবধি বহু কঠিন লক্ষ্য হাসিলেরও এক মোক্ষম অস্ত্র।’ জুডাস তো চুমু খেয়েই ধরিয়ে দিয়েছিলেন যিশুকে। ইহুদিরা তাদের ধর্মগ্রন্থ পাঠের শেষে টোরাকে চুমু খান। নামাজ পড়ার পর মসজিদের মেঝেতে চুমু খাওয়া মুসলমানদের একটি প্রচলিত রেওয়াজ। আর সম্মান জানাতে হাতে চুমু খাওয়া পশ্চিম দুনিয়ার এক সুপ্রাচীন রীতি। বর্তমানে চুমুকে কুশল বিনিময় ও অভিবাদনের একটি অংশ হিসেবেও মনে করা হয়।
আদি উৎপত্তি:
সংস্কৃত ‘চুম্বন’ শব্দটি থেকে ‘চুমু’ শব্দের উদ্ভব হয়েছে। আবেগের বশবর্তী হয়ে মানুষ যখন প্রিয়জনকে চুম্বন করে তখন সেই প্রেরণাটি আসে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি থেকে। কিন্তু অধ্যাপক ব্রায়ান্ট এর মতে, এর সঙ্গেৃ প্রবৃত্তির সংযোগ নেই বরং এটি এমন একটি ক্রিয়া যেটি আমরা শিখি আমাদের পরিবেশ থেকে অর্থাৎ এটি একটি ‘লার্নড বিহেভিয়ার’। চুম্বনের উৎপত্তি ও বিস্তার নিয়ে ২০ বছরব্যাপী গবেষণায় তিনি নিশ্চিত হন যে, চুম্বন সার্বজনীন কোনো সংস্কৃতি নয়। তার মতে, ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চুম্বনের চর্চা সীমাবদ্ধ ছিল মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপে। মার্কিন, অস্ট্রেলিয়ান, এস্কিমো অথবা আফ্রিকানদের মাঝে এর চর্চা ছিল না।
অধ্যাপক ব্রায়ান্ট দাবি করেন, চুম্বনের উৎপত্তি আসলে ভারতে এবং এ ছাড়াও তিনি বলেন, ‘kiss’ শব্দটিই আসলে আরেকটি প্রমাণ, কারণ তিনি ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণ পেয়েছেন যে এই শব্দটির উৎসও ভারত। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালের দিকে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পাঞ্জাব জয় করার পর এটি বিস্তার লাভ শুরু করে। আলেকজান্ডারের সেনাপতিরা বাড়ি ফিরে যাবার সময় এই চর্চাটিকেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়। শুনতে অবাক লাগলেও তথ্য প্রমাণও সেই কথাই বলে। ব্রায়ান্ট তার গবেষণায় লক্ষ্য করেন, হিন্দু ধর্মের মূল শাস্ত্র, বেদ এর কিছু স্থানে উল্লেখ আছে মুখ দিয়ে ‘স্পর্শ’ করার কথা। কামসুত্রের বেশ কিছু স্থানেও দেখা যায় চুম্বন এবং এর কৌশলের উল্লেখ। এই তথ্যগুলোকে ব্রায়ান্ট বিবেচনা করেন সূত্র হিসেবে যেগুলো প্রমাণ করে যে চুম্বনের উৎপত্তি ভারতেই হয়। ব্রায়ান্ট তার গবেষণায় ধর্মীয় এবং প্রথাগত ক্ষেত্রে চুম্বনের ইতিহাসও অন্তর্ভুক্ত করেন। যেমন ইহুদিধর্মে ধর্মগ্রন্থ তাওরাত চুম্বনের প্রথা এবং পাশ্চাত্যে মিসেলটো লতার নিচে চুম্বনের চর্চা ইত্যাদি।
সুমেরীয় লিপি ও হায়রোগ্লিফের প্রেমের ক‘বিতায়ও উঠে এসেছে চুম্বনের বর্ণনা। চুম্বনের ইতিহাসের সর্বপ্রাচীন আরেকটি মত পাওয়া যায়। আদিম মানুষ ভাষার ব্যবহার জানত না। সভ্য মানুষের মতো তারা জানাতে পারত না নিজস্ব অনুভূতির কথা। তাই বলে তাদের মধ্যে প্রেম ভালোবাসার ঘাটতি ছিল না। বরং নির্বাক সেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল অন্যরকম। আদিম যুগে জঙ্গল থেকে শিকার করা বা সংগ্রহ করে আনা খাদ্য সকলে মিলে ভাগ করে খেত গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ। তখন আগুনের ব্যবহারও জানা ছিল না তাদের। তারা জানত না কিভাবে শক্ত খাবারকে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। ছোট্ট দুধের শিশুকে শক্ত সেই খাবার খাওয়াতে সমস্যায় পড়তেন মা। অপাচ্য খাবার খাইয়ে তো আর সন্তানকে বিপদে ফেলতে পারেন না তিনি। আবার মায়ের স্তন্যপানের বাইরে অন্য খাবার না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে শিশু। কি উপায়ে কাঁচা ফল, সবজি বা মাংস শিশুকে খাওয়ানো যায় তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যেতেন মায়েরা। একসময় তারা প্রকৃতি থেকে পশু পাখিদের দেখে একটি পন্থা অবলম্বন করা শুরু করলেন। সংগৃহীত খাবার প্রথমে মুখে নিয়ে ভালো করে দাঁত দিয়ে চিবিয়ে নরম করে মায়েরা সেই চিবানো নরম খাবার ঠোঁট দিয়ে শিশুর মুখের মধ্যে প্রবেশ করানো শুরু করে। খাবার বিনিময়ের ছলে এভাবেই মা ও সন্তানের অধরে অধরে স্পর্শের হাত ধরে জন্ম নেয় প্রেমময় চুম্বন।
খ্রিস্টের জন্মের ২ হাজার বছর পূর্বের ইতিহাস অবশ্য জানাচ্ছে অন্য এক চুম্বন তত্ত্বের কথা। সে সময় পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে প্রচলিত ছিল এক অদ্ভুত ধর্মীয় প্রথা। দু’জন মানুষের ঠোঁটসহ মুখাবয়ব নিবিড়ভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে নাকি মানব শরীরের আত্মার একত্রীকরণের পথ সহজ হয়ে ওঠে। এই বিশ্বাসে আত্মায় আত্মায় সঙ্গম ঘটাতে ২ জন মানুষ একে অপরকে চুম্বন করতেন। সেই রীতিই কালক্রমে ভারত, রোম, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জনগোষ্ঠীর জীবনে উৎসবে পরিণত হয়। প্রাচীন রোমানরা যেকোনো চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করত চুমুর মাধ্যমে। রোমানরা চুমুকে নানান ভাগে ভাগ করে। তারা চুমুরই তিন রকম নাম দেন- হাতে বা গালে চুমু হলো অসকুলাম, ঠোঁট বন্ধ রেখে ঠোঁটে চুমু হলো বেসিয়াম আর ফরাসী চুম্বনের ধরন হলো সুভিয়াম। বটতলা চুম্বন পদ্ধতি বা দেবতার পদচুম্বন কিন্তু অনেক পরে এসেছে। মেয়েদের চুম্বন তিন প্রকার। ‘নির্মিতক, স্ফুরিতক ও ঘট্টিতক। এই ধরনের চুম্বন মেয়েরাই প্রয়োগ করে থাকে। ১৯২০ সালে জাপানে প্রকাশ্যে চুম্বনের রীতি এতটাই অপরিচিত এবং অস্বাভাবিক মনে করা হত, যে ভাস্কর রডিন এর ভাস্কর্য ‘দ্য কিস’ প্রদর্শনী করার সময় একে বাঁশের চাটাই দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল এবং শুধুমাত্র বিশেষ অনুমোদন পাবার পরই কাউকে এটি দেখতে দেয়া হত।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উপকারিতা:
ঊনিশ শতকে চুম্বন নিয়ে গবেষণা শুরু হয়, যাকে বলে ‘ফিলেম্যাটোলজি’। এটি চুমুবিদ্যার বৈজ্ঞানিক নাম। এই বিদ্যায় বিজ্ঞানীদের নানা গবেষণায় বেরিয়ে আসে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। ফিলেম্যাটোলজিস্টরা সায়েন্স ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় জানিয়েছেন, মাত্র এক মিনিটের চুম্বনে ২৬ ক্যালরি শক্তি খরচ হয়। চুমুতে যাদের ভীতি বা অনাগ্রহ তারা ফিলেমাটোফোবিয়ায় আক্রান্ত। ১৯৯৭ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখেছেন, চুম্বনের সময় মানব মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। ফলে ভালোলাগার অনুভূতিতে ভরে ওঠে শরীর মনে। ডা. আর্থার সাজবো জানিয়েছেন, যারা নিয়মিত চুমু খেয়ে দিন শুরু করেন তারা ড্রাইভিং করেন দারুণ ভালো। অন্যদিকে, চুম্বনের ফলে দু’জন মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যায় জীবাণু। এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা আরো কিছু তথ্য জানিয়েছেন, মানুষের মুখের লালায় থাকে দশ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন জীবাণুগোষ্ঠী কিন্তু এ কথা শুনে চুমু খাওয়া থেকে বিরত থাকলে বিপদ আরো বাড়বে। কেননা স্বাভাবিক অবস্থায় এসব জীবাণু মুখের লালায় ঘোরাফেরা করে, ওতপেতে থাকে সুযোগের অপেক্ষায়, কি করে হানবে আক্রমণ, সৃষ্টি করবে সংক্রমণ। আর এ থেকে বাঁচতে চুমু খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রসঙ্গত, এই সিঙ্গল সেল অর্গানিজমরা আসে মূলত খাবার, বাতাস, ময়লা হাতের মাধ্যমে। তবে কোটি কোটি জীবাণুর কথা শুনে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কেননা চুমু খাওয়ার আগের মুহূর্তেই স্যালাইভাতে এমন কিছু কেমিক্যালস তৈরি হয় (অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল কেমিক্যালস) যা মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করে ফেলে শরীরের অনিষ্টকারী এসব ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়াকে। আরো এক ধরণের ভাইরাস রয়েছে সাইটোমেগালোভাইরাস, যা গর্ভবতী নারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু গর্ভধারণের আগেই চুম্বনের মাধ্যমে একটু একটু করে তার শরীর যদি এই ভাইরাসে অভ্যস্ত হয়ে যায় তবে তার শরীরে গড়ে উঠবে এই ভাইরাস ঠেকানোর ব্যবস্থা। ভাইরাসটির প্রতি এই ইমিউনিটি তার সন্তানের মাঝেও সঞ্চারিত হতে পারে। চুম্বনকারীর মস্তিষ্কের চুম্বনের সময় বিশেষ কিছু নিউরো হরমোন নিঃসৃত হয়, যা সাময়িকভাবে ডিপ্রেশন, এ্যাংজাইটি, স্ট্রেস কাটাতে সাহায্য করে। চুম্বনের সময় নিঃসৃত এসব হরমোন প্রাকৃতিক এন্টিডিপ্রেসেন্ট এর কাজ করে। বাবা মায়ের ডিপ্রেশন কাটতে পারে সন্তানের চুম্বনে, সন্তানের উৎকণ্ঠা দূর হয় বাবা-মায়ের চুম্বনে। একইভাবে স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধুরা উপকার পেতে পারেন। চুম্বনের সময়ে মুখের ৩০টি পেশি ব্যবহৃত হয়। এতে আপনার এই পেশীগুলো সুস্থ ও সচল থাকে, গাল ও চোয়াল থাকে টানটান।
অপকারিতা:
চুম্বনের কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। এ থেকে শুধু যে ভালো জীবাণু ধ্বংসের এ্যান্টিডট তৈরি হয় তা না। আমস্টারডামে বিশ্বের প্রথম জীবাণু সংক্রান্ত গবেষণাগারের গবেষকদের নিয়ে একটি পরীক্ষা চালিয়েছেন রেমেকো কর্ট। তারা ২১ জন যুগলের উপর সমীক্ষা চালান। চুম্বনের পদ্ধতি, কতক্ষণ গভীর চুম্বন করেন, এসব বিষয়ে তাদের জিজ্ঞেস করা হয়। এরপর ওই যুগলদের বিশেষ জীবাণু মিশ্রিত মিশ্রণ খাইয়ে একে অপরকে চুম্বন করানো হয়। চুম্বনের পর করা হয় পরীক্ষা। দেখা যায় লালায় জীবাণুর খোঁজ। যা পরীক্ষা করে দেখা যায়, ১০ সেকেন্ডের চুম্বনে প্রায় ৮ কোটি জীবাণু আদান-প্রদান হয়েছে। এর থেকেই এই সিদ্ধান্তে আসেন গবেষকরা। তারা আরো জানিয়েছেন, ‘যেসব যুগলরা গড়ে দিনে ৯ বার গভীর চুম্বন করেন, তাদের ক্ষেত্রেও সমপরিমাণ জীবাণু আদান-প্রদান হয়ে থাকে।’