যখন আমরা একটি গল্প কিংবা নাটকের চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনো সমস্যা লক্ষ্য করি তখন সেই সমস্যা খুব একটা জটিল মনে হয় না আমাদের কাছে। ধরা যাক, একটি গল্পের দুটি চরিত্রের মধ্যে কোনোভাবে বোঝাপড়া হয়ে উঠছে না। তারা একে অন্যের কাছে নিজেদের সমস্যার কথা প্রকাশ করতে পারছে না। তখন আমরা একটু বিরক্তি নিয়ে বলি, ‘আরে ভাই, তাদের সমস্যার কথা একে অপরের সাথে শেয়ার করলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিংবা একে অন্যকে সত্য কথাটা বলে দিতে পারে। তাহলে তাদের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি আর থাকবে না।’
অথবা ধরুন, আপনার বন্ধু তার মনের কথাগুলো তার পছন্দের মানুষকে বলতে পারছে না। আপনার নিকট সে পরামর্শ চাইলে আপনি নিশ্চয়ই বলবেন, কোনো কিছু না ভেবে মনের কথাগুলো যেনো সে বলে দেয়। আপনার দৃষ্টিকোণে ব্যাপারটা যতটা সহজ মনে হবে আদতে বিষয়টা তার নিকট ততটাও সহজ নয়।
অন্যকে উপদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে বা পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা পটু। একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা বুঝতে পারি, কোন বিষয়টি আমাদের জন্য ভালো। আমরা বুঝতে পারি, জীবন দেখতে কেমন হওয়া উচিৎ। আপনি নিশ্চয়ই জানেন ভালো ও সুস্থ থাকতে হলে কোন খাবার গুলো আমাদের গ্রহণ করা উচিৎ। প্রোডাক্টিভ জীবন পরিচালনা করতে হলে কোন অভ্যাসগুলো আমাদের গড়ে তোলা উচিৎ। এমনকি আমরা আমাদের কাছে মানুষদের এবং বন্ধুদের প্রায়ই পরামর্শ দিই যে ভালো থাকতে হলে এবং ভালো জীবন অতিবাহিত করতে হলে কি কি করা উচিৎ বা করা দরকার। আমরা এমন পরামর্শ দিই যা আদতে আমরা নিজেরাই পালন করি না। আমরা আজ সকালে যা করেছি, তা অন্য কাউকে করতে দেখলে আমরা খুব সহজে তার সমালোচনা করি। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর সলোমন প্যারাডক্স আপনাকে দিতে পারে। এই অভ্যাসটি ত্যাগ করতে সলোমন প্যারাডক্স বিবেচনা করা যেতে পারে। এই প্যারাডক্সের মূল বিষয় আপনাকে এই অভ্যাস পরিবর্তনে সাহায্য করতে পারে।
কে এই সলোমন?
ধর্মগ্রন্থ অনুসারে সলোমন ছিলেন একজন বিত্তবান রাজা। যার জন্ম আনুমানিক ১০১১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। বলা হয়ে থাকে তাঁর হাত ধরেই জেরুজালেম নগর প্রতিষ্ঠিত। ধর্মীয় বিশ্বাস মতে তিনি ছিলেন পুরো পৃথিবীর শাসক। তিনি দীর্ঘ ৪০ বছর পৃথিবী শাসন করেছেন।
রাজা সলোমনের ন্যায় বিচার:
রাজা সলোমন বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিলেন তার বুদ্ধি এবং ন্যায় বিচারের জন্য। রাজা সলোমনের বিচার নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে।
একদিন দুজন মহিলা একটি শিশু নিয়ে রাজার সলোমানের দরবারে হাজির হন। তারা দুজনেই নিজেদের ওই শিশুটির মা বলে দাবি করছিলো। পুরো ঘটনা শুনে রাজা সলোমন সিদ্ধান্ত নিলেন শিশুটিকে সমান দুভাগে কেটে দুজনকে সমানভাগে দিয়ে দেবেন। তিনি লক্ষ্য করলে দুজন নারীর মধ্যে একজন নিশ্চুপ। অপর নারীটি রাজার পা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে অনুরোধ করতে থাকলেন, ‘বাচ্চাটিকে মারবেন না। আমার ভাগের দরকার নেই। বাচ্চাটি ওই মহিলাকে দিয়ে দিন।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজা সলোমন বাচ্চাটির আসল মা-কে চিহ্নিত করতে পারলেন। তিনি শিশুটিকে তার আসল মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে অপর মহিলাটিকে কারাগারে বন্দী করার নির্দেশ দিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে রাজা সলোমন:
রাজা সলোমন তার বিচারে যতটাই নিখুঁত কিংবা বুদ্ধিমান ছিলেন না কেন ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অনেকটা বিশৃঙ্খল। তার একাধিক পৌত্তলিক স্ত্রী এবং উপপত্নী ছিলেন। তার অভিভাবকত্ব বাইবেলে বর্ণিত সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম অত্যাচারী শাসকের জন্ম দিয়েছিলো। যে ছিলো তার পুত্র রেহবিয়াম। যে জুদাহকে (শহর) নরকে পরিণত করেছিলো। রাজা সলোমন সংবেদনশীল জীবন সম্পর্কে খুব কমই চিন্তা করতেন। শেষ বয়সে তিনি রাজ্যের জনগণের উপর ভারী কর আরোপ করেছিলেন। যার ফলে রাজ্যে বিশৃঙখল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো। অপরকে উপদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি যতটা বিচক্ষণ ছিলেন, নিজের ক্ষেত্রে ততটা না। নিজের ক্ষেত্রে সেই বিচক্ষণতা নিস্তেজ হয়ে যায়।
সলোমন প্যারাডক্স:
সহজ ভাষায়, সলোমন প্যারাডক্স হলো মনের অবস্থা, যেখানে আপনি আপনার সমস্যাগুলো সমাধানের চেয়ে অন্যের সমস্যাগুলো বুঝতে এবং সমাধান করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন।
২০১৩ সালে দুজন সাইকোলজিস্ট এবং কগনেটিভ সায়েন্টিস্ট ইগর গ্রোসম্যান ও ইথান ক্রস সলোমন প্যারাডক্সের অস্তিত্বের উপর এবং এই প্যারাডক্স কিভাবে এড়ানো যায় তার উপর পরিক্ষা করেন। তাদের অনুসন্ধানে তিনটি আবিষ্কারের কথা তারা উল্লেখ করেন।
১। মানুষ বুদ্ধিদীপ্তিক যুক্তি দেয় যখন সে অন্য কেউকে পরামর্শ দেয়। অর্থাৎ মানুষ অন্যের সমস্যা সমাধানে যতটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়, নিজের ক্ষেত্রে তার উলটো৷ নিজের সমস্যা সমাধানের চেয়ে অন্যের সমস্যা সমাধান তার কাছে আরো সহজ মনে হয়।
২। যখন আমরা আত্মমগ্নতা (Self immersion) দূর করার চেষ্টা করি। কিংবা আমরা যখন আমাদের নিজেদের সমস্যা থেকে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করি তখন আমরা সুবুদ্ধিপূর্ণ বা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী।
৩। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের সিদ্ধান্ত নেয়ার পাণ্ডিত্য বা ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না।
গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে আমরা সাহিত্যে (Literature) দুটি ভিন্ন ধরণের wisdom বা প্রজ্ঞার আলোচনা পাই। একদিকে থাকে আমাদের সাধারণ জ্ঞান বা প্রজ্ঞা। যাকে বলা হয় আন্তঃব্যক্তিক (Interpersonal) অর্থাৎ আপনার নিজের এবং অন্য কারো মধ্যকার। অপরদিকে ব্যক্তিগত জ্ঞান বা প্রজ্ঞা। যা Intrapersonal যা আপনার মননে বা নিজস্ব বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
এই দুটি বিষয় নিয়ে দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক বিতর্ক রয়েছে। আমরা সমাজে এমন অনেক লোক খুঁজে পাবো যাদের মধ্যে এই দুই ধরণের প্রজ্ঞা বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ – রাজা সলোমনের ছিলো সাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারি। তিনি অন্য মানুষকে পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে ছিলেন পটু। অন্যদিকে আমরা এমন মানুষদের খুঁজে পাই যারা স্মার্ট এবং বিচক্ষণ হলেও পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে ততটা বিচক্ষণ নন। কিন্তু এই দুই সম্পর্কের পিছনে কারণটা কী?
সাধারণ এবং ব্যক্তিগত প্রজ্ঞার মধ্যে পার্থক্যটি এড হোমিনিম আক্রমনের বিরুদ্ধে একটি প্রয়োজনীয় অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে। সর্বোপরি, রাজা সলোমানের মতো অন্যের বিষয়ে বিচক্ষণ কিন্তু ব্যক্তিগত বিষয়ে নির্বোধ হতে পারে। ‘আমি যেমন করি তেমনিভাবে করো কিন্তু আমি যেটা করি সেটা নয়।’ মনোবিজ্ঞান অনুসারে আমরা যা বলি তা প্রায়শই আমরা যা করি তার চেয়ে ভালো।
এই সমস্যা কাটিয়ে উঠার উপায়:
সলোমন প্যারাডক্স আমাদের শেখায়→ আমরা যদি নিজেদের ভালো উপদেশ দিতে চাই, তাহলে আমাদের এক ধাপ পিছিয়ে যাওয়া উচিৎ। আমরা যদি আমাদের নিজেদের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে চাই, তাহলে আমাদের নিজেদের বইয়ের চরিত্রগুলোর মতো কল্পনা করে নিতে হবে। নিচে তিনটি উপায় বর্ণনা করা হয়েছে যা আমাদের এই অভ্যাসটি ত্যাগে সাহায্য করতে পারে।
১। নিজের সাথে কথা বলুন:
আয়নায় নিজেকে দেখুন। নিজের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করুন। প্রথমে এই কাজটি পাগলাটে মনে হতে পারে। তারপরও চেষ্টা করুন। কল্পনা করুন আপনি একজন থেরাপিস্ট এবং আয়নায় ব্যক্তিটি আপনার ক্লায়েন্ট। কিংবা নিজের সামনে একটি খালি চেয়ার রাখুন। এইবার নিজেকে একজন সমালোচক হিসেবে কল্পনা করুন এবং ফাঁকা চেয়ারটিতে একটা চলচিত্রের চরিত্র কিংবা আপনার বন্ধুকে কল্পনা করুন। শুরুতে দুটো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিন→ ‘আপনি কেনো এটি করছেন?’ এবং ‘আপনি কিভাবে তাকে সাহায্য করতে পারেন?’
২। জার্নালিং:
উপরন্তু উপায়টি যাদের নিকট পাগলাটে মনে হবে, যারা সেল্ফ টক করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন না তারা এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে পারেন। নিজের কথাগুলো ডাইরিতে লিখে রাখতে পারেন।
দিনে এমন একটি সময় নির্ধারণ করুন আপনার সুবিধামতো এবং দিনে বা সপ্তাহে আপনার নিজের সঙ্গে ঘটা ঘটনাবলি লিখে রাখার চেষ্টা করুন। তারপর আপনি যা লিখেছেন তা পড়ার চেষ্টা করুন। কল্পনা করুন আপনি একটি বই পড়ছেন। আপনি যা পড়ছেন তা থেকে আপনি নিজেকে কি পরামর্শ দেবেন? যদিও এই পদ্ধতি তাৎক্ষণিক কাজ করবে না। এটির জন্য সময়ের প্রয়োজন। আপনি যদি আপনার লিখা জার্নাল বারবার পড়েন তবে আপনি সহজেই সমস্যাটি বুঝে নিজেকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারদর্শী হবেন।
৩। অন্য কারো সঙ্গে অনুসন্ধান করুন:
এমন কাউকে জিজ্ঞাসা করুন যিনি আপনাকে ভালোভাবে চেনেন। হতে পারে আপনার নিকটাত্মীয় কিংবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিংবা আপনার প্রিয় একটি টিভির চরিত্র নির্ধারণ করুন যাকে আপনি ভালোকরেই চেনেন। তারপর সেই ব্যক্তি সম্পর্কে ভালো করে জানার চেষ্টা করুন। তার একটি সমস্যা নির্ধারণ করুন এবং দেখুন আপনি তাকে কি পরামর্শ দেবেন। যদিও আপনারা দুজন সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন, তবে এই ধরণের তৃতীয় ব্যক্তি নির্বাচন প্রায়ই একটি কার্যকর কৌশল।
আমরা যদি তৃতীয় ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের সমস্যাটি বোঝার চেষ্টা করি তাহলে আমরা আরো ভালো সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবো। তাত্ত্বিকভাবে এটি অর্জন করা সহজ মনে হলেও যেকোনো কঠিন বা জটিল মূহুর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং৷
তো, আপনার কোন ধরণের প্রজ্ঞা বা wisdom আছে? আপনি কি সাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারি নাকি ব্যক্তিগত? আপনি কি ব্যক্তিগতভাবে বেশ বুদ্ধিমান কিন্তু পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন বিচক্ষণ নন? নাকি আপনি রাজা সলোমনের মতো→ অন্যকে পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত জীবনে বিভ্রান্ত এবং অপেশাদার!