আমরা অনেকেই সঞ্চিত অর্থ কোথাও বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করতে চাই। আর বিনিয়োগের অন্যতম একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হলো পুঁজিবাজার বা শেয়ার মার্কেট। কিন্তু পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে অনেকেই না বুঝে বিনিয়োগ করে লোকসানের মুখে পড়েন। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য এই গাইডলাইনটি তৈরি করা হয়েছে। আসুন জেনে নিই, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আগে কী কী বিষয় জানা জরুরি।
১. আর্থিক সাক্ষরতা বা ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি কী?
সহজ কথায়, টাকা-পয়সা কীভাবে কাজ করে, কীভাবে আয়-ব্যয় ও সঞ্চয় করতে হয় এবং সেই সঞ্চয় কীভাবে সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করে সম্পদ বাড়ানো যায়—এই জ্ঞানটুকু থাকাই হলো আর্থিক সাক্ষরতা। পুঁজিবাজারে আসার আগে এই প্রাথমিক জ্ঞান থাকা খুব জরুরি।
২. বিনিয়োগের আগে যা ভাববেন
হুট করে অন্যের দেখাদেখি বিনিয়োগ করবেন না। নিজেকে প্রশ্ন করুন:
আপনার বিনিয়োগের লক্ষ্য কী? (দীর্ঘমেয়াদী সম্পদ গড়া নাকি স্বল্পমেয়াদী লাভ?)
আপনি কতটা ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত? (পুঁজিবাজারে লাভ যেমন আছে, লোকসানের ঝুঁকিও আছে)
আপনার হাতে অলস অর্থ আছে তো? (প্রয়োজনীয় সংসার খরচের টাকা শেয়ার বাজারে খাটানো উচিত নয়)
৩. শেয়ার বাজারের প্রাথমিক ধারণা
পুঁজিবাজারকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
প্রাইমারি মার্কেট (IPO): যখন কোনো কোম্পানি প্রথমবারের মতো সাধারণ মানুষের কাছে শেয়ার বিক্রি করে, তখন তাকে আইপিও বা প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বলে। এখানে ঝুঁকি তুলনামূলক কম।
সেকেন্ডারি মার্কেট: আইপিও-তে শেয়ার পাওয়ার পর সেগুলো যেখানে কেনাবেচা হয়, সেটাই সেকেন্ডারি মার্কেট। এখানে দাম প্রতিদিন বাড়ে বা কমে।
৪. একটি ভালো শেয়ার চেনার উপায় (মৌল ভিত্তি)
বিনিয়োগের আগে কোম্পানির কিছু ‘মৌল ভিত্তি’ বা ফান্ডামেন্টাল বিষয় অবশ্যই যাচাই করতে হবে। যেমন:
EPS (শেয়ার প্রতি আয়): কোম্পানিটি প্রতি শেয়ারে কত টাকা লাভ করছে? বিগত কয়েক বছরে তাদের লাভের ধরণ কেমন?
NAV (শেয়ার প্রতি সম্পদ): কোম্পানির মোট সম্পদ ও দায়ের অনুপাত কেমন?
PE Ratio (মূল্য-আয় অনুপাত): এটি যত কম হয়, বিনিয়োগের জন্য তত নিরাপদ ধরা হয়।
লভ্যাংশ বা ডিভিডেন্ড: কোম্পানিটি নিয়মিত লভ্যাংশ দেয় কিনা এবং সেই লভ্যাংশের হার কেমন।
পরিচালনা পর্ষদ: কোম্পানিটি যারা চালাচ্ছে, তাদের সুনাম ও দক্ষতা কেমন।
৫. বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘সোনালী নিয়ম’ (করণীয়)
একজন সচেতন বিনিয়োগকারীর যা যা করা উচিত:
বিক্ষিপ্ত বিনিয়োগ (Portfolio Diversification): সব টাকা একটি কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন না। বিভিন্ন খাতের (যেমন: ব্যাংক, ওষুধ, সিমেন্ট) ভালো কোম্পানিতে টাকা ভাগ করে বিনিয়োগ করুন। এতে এক জায়গায় লোকসান হলেও অন্য জায়গা থেকে তা পুষিয়ে নেওয়া যায়।
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা: শেয়ার বাজার জুয়া খেলার জায়গা নয়। এখানে ধৈর্য ধরে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
জেনে ও বুঝে বিনিয়োগ: অন্যের কথায় বা হুজুগে কান না দিয়ে নিজে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিন। প্রয়োজনে পেশাদার বিনিয়োগ বিশ্লেষকের পরামর্শ নিতে পারেন।
৬. যা কখনোই করবেন না (বর্জনীয়)
গুজব: “অমুক শেয়ারের দাম কাল বাড়বে”—এমন গুজবে কান দিয়ে শেয়ার কিনবেন না।
ঋণ করে বিনিয়োগ: কখনোই ধার-দেনা করে বা সংসারের জমানো শেষ সম্বল বিক্রি করে শেয়ার বাজারে আসবেন না।
অতিরিক্ত লাভ: অস্বাভাবিক বা গ্যারান্টিযুক্ত লাভের প্রলোভনে পড়বেন না। মনে রাখবেন, যেখানে লাভের সম্ভাবনা অস্বাভাবিক বেশি, সেখানে ঝুঁকিও অনেক বেশি।
৭. বিও (BO) অ্যাকাউন্ট খোলার সতর্কতা
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের প্রথম ধাপ হলো একটি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (BO) অ্যাকাউন্ট খোলা। কোনো অনুমোদিত ব্রোকারেজ হাউজ থেকেই এটি খুলতে হয়। অ্যাকাউন্ট খোলার সময় নমিনি এবং ব্যাংকের তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করুন, যাতে ভবিষ্যতে কোনো জটিলতা না হয়।
পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতির আয়না। এখানে যেমন সম্পদ গড়ার সুযোগ আছে, তেমনি না বুঝে আসলে সর্বস্ব হারানোর ভয়ও থাকে। আপনার সচেতনতাই আপনার পুঁজির একমাত্র রক্ষাকবচ।
এই পোস্টটি শেয়ার করে আপনার পরিচিতজনদের সচেতন হতে সাহায্য করুন।

