শেয়ার করুন
সাইন আপ করুন
লগিন করুন
পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? আপনার ইমেইল এড্রেস দিন। ইমেইলের মাধ্যমে আপনি নতুন পাসওয়ার্ড তৈরির লিংক পেয়ে যাবেন।
আপনি কেন মনে করছেন এই প্রশ্নটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই উত্তরটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই ব্যক্তিকে রিপোর্ট করা উচিৎ?
অসীমের বিশালত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা অসহায় হয়ে দেখবো আমাদের চিন্তার পরিধি কত ছোট! আমাদের তুচ্ছতা আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিশালত্ব নিয়ে চিন্তা করলে নিজেদের যে কতটা অসহায় মনে হয়, তার একটা ছোট্ট উদাহরণ এটি। অসীমের বিশালত্ব উপলব্ধি করার জন্য পাঠকের গভীর গাণিতিক জ্ঞান দরকার নেই, তবে নিঃসন্দেহে গভীরতম চিন্তাশক্তির প্রয়োজন!
লেখকের ছোটবেলার একটা অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করা যাক। খুব ছোটবেলায় আমার এক বন্ধুর সাথে একবার তর্ক লেগে গেল, কার কয়টা খেলনা আছে। আমি অনেক কষ্টে গুনে বললাম, আমার সব মিলিয়ে আটটি খেলনা আছে। বন্ধু বলল তার দশটি। এবার তো পড়ে গেলাম বিপাকে! বন্ধুর কাছে হেরে যাওয়া যায় না, আমি বললাম আমার পনেরটা! এবার বন্ধুও চিন্তায় পড়ে গেল! অনেক ভেবে বলল, আমার গুনতে একটু ভুল হয়ে গেছে, আমার আসলে বিশটা! এবার অনেক ভেবে বললাম, আমার একশটা!
আমি তখন মোটে গুনতে পারি বিশ পর্যন্ত! একশো বলে খুব খুশি হয়ে গেলাম। এবার বন্ধু খুব চিন্তায় পড়ে গেল। ঐ বয়সে একশ অনেক বড় সংখ্যা, এর থেকে বড় কোনো সংখ্যা আছে কি না আমাদের কারোরই জানা নেই। এবার বন্ধু একটু চালাকি করে ফেলল! বলল, আমার যতগুলো খেলনা আছে, বন্ধুর নাকি তার চেয়ে এক বেশি! এর পরে আর কোনো কথা থাকে না। মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলাম। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, একশোর চেয়ে বড় আর কী আছে?
অর্থাৎ একটা শিশু খুব চিন্তা করেও তার পরিধি একশো থেকে বড় করতে পারেনি! আমাদের পূর্বপুরুষদের সংখ্যার ধারণা ছিল এক আর অনেক! গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, অনেক প্রাণী তিন পর্যন্ত গুনতে পারে! আসুন দেখি, আমরা কত পর্যন্ত গুনতে পারি!
খাবার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে শিম্পাঞ্জীরা সংখ্যার ধারণা কাজে লাগায়; Image source: bbc.com
আমাদের পৃথিবী কিন্তু অনেক বড়, প্রায় ৫১০ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। এবার সূর্যের দিকে তাকান। সূর্যের মধ্যে আপনি এক মিলিয়ন পৃথিবী রাখতে পারবেন। আরেকটু বড় পরিসরে ভাবুন, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে সূর্যের মতো প্রায় ৪০০ বিলিয়ন তারা আছে। আর আমাদের জানা মতে, মহাবিশ্বে ১০০ বিলিয়ন শনাক্ত করা যায় এমন গ্যালাক্সি আছে, শনাক্ত করা যায়নি, এমন গ্যালাক্সির সংখ্যা নিশ্চয়ই আরও বেশি। আর আপনি জানেন কি, ইদানীং কিছু গবেষণামতে, মহাবিশ্বও কিন্তু একটি নয়। স্ট্রিং থিওরি মতে, মোটামুটি 10^500 টি (১ এর পর ৫০০টি শূন্য)! তবে এই সংখ্যাটি নিশ্চিত নয়। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন,
আপনি কি ভাবতে পারেন, এই সংখ্যাগুলো কত বড়? এদের কাছে আমরা কতটা তুচ্ছ? আসুন, এবার আমাদের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। অসীম এই সংখ্যাগুলোর চেয়েও বড়!
মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির সঠিক সংখ্যা আমরা আজও জানি না; Iamge source: earthsky.org
আপনাকে যদি বলা হয়, পৃথিবীতে যতগুলো জোড় সংখ্যা আছে, ততগুলোই স্বাভাবিক সংখ্যা আছে, আপনি কি মানবেন? নিশ্চয়ই না (১-১০ এর মধ্যে জোড সংখ্যা ৫টি, স্বাভাবিক সংখ্যা ১০টি)! কিন্তু আমাদের ভাবনার জগত কেবল গণনাযোগ্য সংখ্যা নিয়ে কাজ করে বলেই এটা মানতে আপনার কষ্ট হচ্ছে। আপনি না গুনে কীভাবে বুঝবেন আপনার দু’হাতে সমান সংখ্যক আঙুল আছে? আপনি প্রতিটি আঙুলের বিপরীতে আরেকটি আঙুল রাখতে পারবেন, তাই এরা সমান। একে গণিতে বলে One-one correspondence। এই পদ্ধতিতেই আমরা প্রমাণ করতে পারি, জোড় সংখ্যার সংখ্যা আর মোট সংখ্যার সংখ্যা সমান। (২-১, ৪-২, ৬-৩, ৮-৪….. এরকম জোড়া কিন্তু চলতেই থাকবে)
2 4 6 8 10 12 ……….
1 2 3 4 5 6 ………..
এভাবে প্রতিটি সংখ্যার বিপরীতে আরেকটি জোড় সংখ্যা পাওয়া যাবে, মানে আমাদের বিষয়টি প্রমাণ হয়ে গেল। কিন্তু এখানে একটা ‘কিন্তু’ থেকেই গেল! মোট জোড় সংখ্যা আছে অসীম সংখ্যক। আবার মোট স্বাভাবিক সংখ্যাও আছে অসীম সংখ্যক। আপনার যদি ওপরের প্রমাণে ‘কিন্তু’টাই পছন্দ হয়ে থাকে, তাহলে এই দুই অসীম সমান না! অর্থাৎ অসীমেরও ছোট-বড় আছে, সব অসীম অন্য অসীমের সমান নয়!
অসীমগুলো যে অন্য অসীম থেকে আলাদা এরকম প্রস্তাবনা প্রথম দেন জর্জ ক্যান্টর (তিনি সেট তত্ত্বের জনক)। এর নাম The Continuum Hypothesis।
“Continuum Hypothesis” এর প্রস্তাবনাকারী জর্জ ক্যান্টর; Image source: wikipedia.org
এই তত্ত্বে বলা হয়, প্রত্যেক অসীম অন্য অসীম থেকে আলাদা। এক অসীম অন্য অসীম থেকে ছোট-বড় হতে পারে। ডেভিড হিলবার্টের মতে, গণিতে এই তত্ত্ব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অপ্রমাণিত সমস্যা। কেন? কারণ কার্ল গোডেল প্রমাণ করেছেন, এই তত্ত্ব কখনও মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না। অন্যদিকে পল কোহেন প্রমাণ করেছেন, একে সত্য প্রমাণ করাও সম্ভব নয়! এটা প্রমাণ করে যে, বিজ্ঞানে বা গণিতে এখনও অনেক উত্তর দেয়া সম্ভব হয়নি এমন প্রশ্নের অস্তিত্ব রয়েছে!
এবার আমাদের চিন্তাশক্তির আরেকটু উচ্চস্তরে যাওয়া যাক। এর নাম The infinity Paradox, এর প্রস্তাবনাকারী ডেভিড হিলবার্ট।
চিন্তা করুন একটি হোটেলের কথা যেখানে রুমের সংখ্যা অসীম। কোনো এক রাতে প্রত্যেকটি রুম ভর্তি, কোনো রুম ফাঁকা নেই। হোটেলের নাম আমরা ধরে নিই ইনফিনিটি হোটেল, আর হোটেলের ম্যানেজার গণিতবিদ জেফ্রি। হোটেল ভর্তি করে জেফ্রি রাতে ঘুমিয়েছেন। হঠাৎ একজন নতুন অতিথি আসলো, যে আরেকটা রুম চায়। গণিতবিদ জেফ্রি কিন্তু তাকে ফিরে যেতে দেননি, তার জন্যও ইনফিনিটি হোটেলে আরেকটি রুমের বরাদ্দ করা হলো। কীভাবে? জেফ্রি এক নম্বর রুমের লোককে বলল দুই নম্বরে যেতে, দুই নম্বর রুমের লোককে বলা হলো তিন নম্বর রুমে যেতে। মানে সব রুমের লোককে তার ঠিক পাশের রুমে যেতে বলা হল। এখন আপনি ভাবতে পারেন, শেষ রুমের লোকটি কোথায় যাবে? কিন্তু এটা তো কোনো চল্লিশ রুমের হোটেল না, এটি ইনফিনিটি হোটেল। এখানে শেষ রুম বলে কোনো কথা নেই। n তম রুমের লোকটি n+1 তম রুমে চলে গেল, এক নম্বর রুম খালি করে নতুন লোকটিকে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করা হলো।
হিলবার্টের ইনফিনিটি প্যারাডক্স; Image source: ed.ted.com
এবার জেফ্রির জন্য আরেকটু কঠিন সমস্যা, এবার একটা বাস এলো চল্লিশজন মানুষ নিয়ে, এরা আরও চল্লিশটা রুম চায়। চট করে জেফ্রি সমাধান করে ফেলল, এক নম্বর রুমের লোককে বলা হলো একচল্লিশ নম্বর রুমে, দুই থেকে বিয়াল্লিশ নম্বর রুমে, n রুমের লোক চলে গেল (n+40) নম্বর রুমে, চল্লিশটি রুম ফাঁকা হয়ে গেল, চল্লিশজনের জায়গা হয়ে গেল!
আসুন, জেফ্রিকে আরেকটু কঠিন সমস্যা দেয়া যাক। দেখি এবার জেফ্রি কী করে! এবার তার হোটেলে একটা বাস পাঠানো হলো, যেখানে লোকের সংখ্যা অসীম। এবার কী করে তাদের জায়গা দেওয়া হবে? এবার কিন্তু আর জেফ্রি যোগের ধারণা দিয়ে এত লোকের জন্য রুম খালি করতে পারবে না, কারণ n+∞ কোনো নির্দিষ্ট রুমের নম্বর না, জেফ্রি কাউকে গিয়ে হুট করে সেই রুমে যেতে বলতে পারে না। এবার কিছুক্ষণ ভেবে এক অভিনব বুদ্ধি বের করল। এক নম্বর রুমের লোককে বলা হল দুই নম্বরে যেতে, দুই নম্বরের লোক গেল চারে, তিন নম্বর রুম থেকে পাঠানো হল ছয় নম্বর রুমে। n নম্বর রুম থেকে 2n নম্বর রুমে পাঠিয়ে দিলে সব জোড় সংখ্যার রুম ভরে গেল, আর বিজোড় সংখ্যার রুম ফাঁকা হয়ে গেল। এখন নিশ্চয়ই জানেন বিজোড় সংখ্যা আছে মোট অসীম সংখ্যক, তাই অসীম সংখ্যক লোকের জায়গা হয়ে গেল।
পাঠক, এবার সময় এসেছে আপনার সিট বেল্ট টাইট করে নেয়ার। কারণ এবার আঘাত আসবে স্বাভাবিক মানুষের চিন্তার প্রায় সর্বোচ্চ স্তরে! জেফ্রি এবার তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে! এবার অসীম সংখ্যক লোক নিয়ে একটি-দুটি নয়, পুরো অসীম সংখ্যক বাস চলে এসেছে, সবাই গণিতবিদ জেফ্রির কাছে ইনফিনিটি হোটেলে জায়গা চায়!
এবার জেফ্রি পড়ে গেল মহাবিপদে। অনেক চিন্তা করে তার মনে পড়লো গুরু ইউক্লিডের কথা। তিনি বলেছেন, মৌলিক সংখ্যা আছে অসীম সংখ্যক। জেফ্রি আইডিয়া পেয়ে গেল! এক নম্বর রুমের লোককে পাঠানো হলো দুই নম্বর রুমে, দুই নম্বর রুম থেকে চার নম্বর রুমে, তিন থেকে আটে, চার থেকে ষোলতে… বুঝতে পারছেন? এখানে n নম্বর রুমের লোককে 2^n নম্বর রুমে পাঠানো হলো। দুইয়ের ঘাত বাদে সব রুম কিন্তু ফাঁকা হয়ে গেল।
প্রথম বাসের সব লোককে এবার বলা হলো ১ নম্বর ঘরে যেতে। পরের বাসের লোককে পাঠানো হলো ৩, ৯, ২৭, ৮১, …3^n… নাম্বার রুমে। পরের মৌলিক সংখ্যা পাঁচের ঘাতে, পরের বাসে সাতের ঘাতে। এভাবে প্রতিটি বাসের জন্য একটি করে মৌলিক সংখ্যার ঘাতে তাদের জায়গা হলো। অসীম সংখ্যক মৌলিক সংখ্যা থাকায় অসীম সংখ্যক বাসের লোকদের জায়গা হলো। এভাবে জেফ্রি তার অসীমের মধ্যে অসীম সংখ্যক অসীমের জায়গা করে দিল!
কী! প্যাঁচ লেগে গেল? আরেকবার পড়ুন। তা-ও না বুঝলে চিন্তার কারণ নেই, কারণ You are not alone!
ইউক্লিড প্রমাণ করেছিলেন, মৌলিক সংখ্যার সংখ্যা অসীম। তাঁর বই “Elements” এর একটি খণ্ডিত অংশ; Image source: wikipedia.org
এবার আমরা জেফ্রির আয়ের কথা ভাবি, তার তো অনেক বড়লোক হয়ে যাবার কথা। যদি প্রতি রুমের জন্য জেফ্রি এক টাকা করে পায়, তাহলে রাতের শুরুতে জেফ্রির ছিল অসীম টাকা, কিন্তু রাতের শেষেও তার আয় অসীম টাকাই!
আপনি কি আন্দাজ করতে পারছেন, অসীম কত বড়? এতক্ষণ আমরা যে অসীম নিয়ে আলোচনা করলাম, তা হলো অসীমের সর্বনিম্ন স্তর, কারণ আমরা কেবল স্বাভাবিক সংখ্যার ভেতরেই অসীম নিয়ে আলোচনা করেছি! আপনারা যদি অসীম সম্পর্কে সামান্য ধারণাও পেয়ে থাকেন, অসীমের বিশালত্ব আপনাকে নাড়া দেয়, তাহলেই লেখার স্বার্থকতা!
এখন আসুন, আমরা আমাদের প্রশ্ন নিয়ে শেষবারের মতো ভাবি। অসীম তাহলে কত বড়? এর উত্তর আসলে খুবই সহজ। কারণ এর উত্তর হলো,