শেয়ার করুন
সাইন আপ করুন
লগিন করুন
পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? আপনার ইমেইল এড্রেস দিন। ইমেইলের মাধ্যমে আপনি নতুন পাসওয়ার্ড তৈরির লিংক পেয়ে যাবেন।
আপনি কেন মনে করছেন এই প্রশ্নটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই উত্তরটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই ব্যক্তিকে রিপোর্ট করা উচিৎ?
পৃথিবীতে অন্যান্য মৌলের তুলনায় স্বর্ণের পরিমাণ খুবই কম। স্বর্ণ যে শুধু পৃথিবীতেই কম তা নয়, সমগ্র মহাবিশ্বেই কম। সমগ্র মহাবিশ্বে কেন কম হবে তার পেছনেও কিছু বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। সে কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে পৃথিবীতে যত পরিমাণ স্বর্ণ আছে তার সামান্যতম অংশও পৃথিবীতে তৈরি হয়নি। অল্প-স্বল্প স্বর্ণ যা-ই আছে তার সবই এসেছে সৌরজগৎ তথা পৃথিবীর বাইরের মহাবিশ্ব থেকে। এটা কীভাবে হয়? এর উত্তর পেতে হলে জানতে হবে গ্রহ-নক্ষত্র কীভাবে গঠিত হয় সে সম্পর্কে।
নক্ষত্র গঠনের মূল উপাদান হলো মহাজাগতিক ধূলি। এই ধূলির মাঝে থাকে হাইড্রোজেন গ্যাস, হিলিয়াম গ্যাস, লিথিয়াম গ্যাস সহ আরো অনেক উপাদান। তবে সেসবের মাঝে সবচেয়ে বেশি থাকে হাইড্রোজেন। এই হাইড্রোজেনই নক্ষত্রের ভেতরে প্রক্রিয়াজাত হয়ে ভারী মৌল গঠন করে। বিগ ব্যাং এর পর পদার্থবিজ্ঞানের কিছু নিয়ম অনুসরণ করে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও লিথিয়াম মৌলগুলো তৈরি হয়েছে। এরপর মহাবিশ্বও প্রসারিত হয়েছে এবং তারাও ছড়িয়ে পড়েছে মহাবিশ্বের সর্বত্র।
কয়েক আলোক বর্ষ ব্যাপী বিস্তৃত এরকম ধূলিমেঘ থেকে নক্ষত্রের জন্ম হয়। প্রক্রিয়াটি বেশ চমকপ্রদ। কোনো একটি এলাকায় কিছু গ্যাস মহাকর্ষ বলের প্রভাবে একত্র হয়। একত্র হলে ঐ অংশের ভর বেড়ে যায়। মহাকর্ষ বলের নিয়ম অনুসারে কোনো বস্তুর ভর বেশি হলে তার আকর্ষণও বেশি হবে। সে হিসেবে ঐ একত্র হওয়া ধূলির মেঘ আরো বেশি বলে আকর্ষণ করবে পাশের মেঘকে। এভাবে আরো ভর বাড়বে এবং আরো বেশি আকর্ষণ ক্ষমতা অর্জন করবে এবং এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। একপর্যায়ে দেখা যাবে ঐ বস্তুটি এত বড় হয়ে গেছে যে সেখানে প্রচণ্ড মহাকর্ষীয় চাপ তৈরি হচ্ছে। নিজের মহাকর্ষের শক্তিতেই নিজের পরমাণু লেপ্টে যাচ্ছে। এমন শক্তিশালী আভ্যন্তরীণ চাপে হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো একত্র হয়ে যায়। দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু একত্র হয়ে একটি হিলিয়াম পরমাণু তৈরি করে। একাধিক ছোট পরমাণু একত্রে যুক্ত হয়ে একটি বড় পরমাণু তৈরি করার এই প্রক্রিয়াকে বলে নিউক্লিয়ার ফিউশন। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়। আমরা যে সূর্যের তাপ শক্তি ও আলোক শক্তি পাচ্ছি তার সবই আসছে এই ফিউশন প্রক্রিয়ায়।
সূর্যের সকল শক্তি আসছে নিউক্লিয়ার ফিউশন থেকে; ছবি: Imgur
ফিউশন প্রক্রিয়ায় একত্র হতে হতে সকল হাইড্রোজেনই একসময় হিলিয়ামে পরিণত হয়ে যায়। তখন হিলিয়াম আবার একত্র হওয়া শুরু হয়। এ পর্যায়ে দুটি হিলিয়াম পরমাণু একত্র হয়ে একটি কার্বন পরমাণু তৈরি করে। হিলিয়াম পরমাণু শেষ হয়ে গেলে কার্বনও আরো ভারী মৌল তৈরি করে। এ প্রক্রিয়ায় পর্যায় সারণীর শুরুর দিকের হালকা মৌলগুলো তৈরি হয়। লোহা বা তার চেয়েও বেশি ভারী মৌলগুলো এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় না। কারণ লোহা তৈরি করতে যে পরিমাণ আভ্যন্তরীণ চাপীয় শক্তি প্রদান করতে হবে সাধারণ নক্ষত্রগুলোর সে শক্তি নেই। যেমন আমাদের সূর্যের কথাই বিবেচনা করা যাক। এর এত তেজ ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য নক্ষত্ররে তুলনায় এটি একদমই মামুলী একটি নক্ষত্র। সূর্যের আভ্যন্তরীণ চাপে শুধুমাত্র হিলিয়াম থেকে কার্বন পর্যন্ত চক্র চলবে। এরপর আরো ভারী মৌল তৈরি করতে যে পরিমাণ চাপ থাকা দরকার সূর্যের তা নেই।
তাহলে লোহা এলো কোথা থেকে? বিজ্ঞানীরা হিসাব-নিকাশ ও পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে লোহা তৈরি হতে পারে। কোনো সুপারনোভা যদি বিস্ফোরিত হয় তাহলে বিস্ফোরণকালের প্রবল প্রবল চাপে সেখানে লোহা তৈরি হওয়া সম্ভব।
সুপারনোভা কেন বিস্ফোরিত হবে সেটাও একটা প্রশ্ন। সাধারণ নক্ষত্রে আভ্যন্তরীণ চাপ ও বহির্মুখী চাপ একটি সাম্যাবস্থায় থাকে। আভ্যন্তরীণ চাপ তৈরি হয় মহাকর্ষের ফলে। আর একাধিক পরমাণু একত্র হয়ে যে প্রবল শক্তি তৈরি করছে তা বাইরের দিকে চাপ দেয়। এই দুই বিপরীতধর্মী চাপের ফলে নক্ষত্র একটি সাম্যাবস্থায় থাকে।
কিছু ক্ষেত্রে নক্ষত্র পুড়তে পুড়তে প্রবল আভ্যন্তরীণ চাপে সংকুচিত হয়ে যায়। সংকুচিত হয়ে সে অবস্থায় আর থাকতে পারে না, প্রবল বিস্ফোরণে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনাকে সুপারনোভা বলে। সংকুচিত হবার সময় কল্পনাতীত যে চাপ দেয় তাতেই লোহের মতো মৌলগুলো তৈরি হয়। একটু বেশি ভারী মৌলগুলো তৈরি হবার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ চাপ পায় তখন।
সুপারনোভা বিস্ফোরণের প্রচণ্ড চাপে তৈরি হয় লোহা; ছবি: Gemini Observatory/Lynette Cook
কিন্তু স্বর্ণ? লোহার পারমাণবিক ভর ৫৬ আর স্বর্ণের পারমাণবিক ভর ১৯৬। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে লোহার চেয়ে স্বর্ণের ভর অনেক বেশি। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন এরকম কোনো বিস্ফোরণই স্বর্ণ তৈরি করার জন্য যথেষ্ট নয়। সাধারণ একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণে যে পরিমাণ চাপ তৈরি হয় তার চেয়েও ১০০ গুণ বেশি চাপ প্রয়োজন হবে স্বর্ণের পরমাণু তৈরিতে। এরকম চাপ তৈরি হতে পারে খুব ভারী কোনো নক্ষত্রের সাথে আরেকটি ভারী নক্ষত্রের সংঘর্ষের ফলে। সাধারণ নক্ষত্রের সংঘর্ষে এত চাপ তৈরি হবে না। এটি সম্ভব খুব ভারী দুটি নিউট্রন নক্ষত্রের সংঘর্ষে কিংবা একটি নিউট্রন নক্ষত্র ও একটি ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষে। উল্লেখ্য ব্ল্যাকহোলও একপ্রকার নক্ষত্র।
তত্ত্ব অনুসারে এভাবে স্বর্ণ তৈরি হবে। কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে তো মেনে নেয়া যায় না। কে জানে এই মহাজগতে এমন কোনো প্রপঞ্চ হয়তো লুকিয়ে আছে যার মাধ্যমে ভিন্ন উপায়ে স্বর্ণ তৈরি হচ্ছে, আর সেই প্রপঞ্চ আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। তবে এ অনিশ্চয়তা নিয়ে আর মন খারাপ করতে হবে না। সম্প্রতি (অক্টোবর, ২০১৭) বিজ্ঞানীরা এর একটি সমাধান পেয়েছেন। এই সমাধান সম্প্রতি পেলেও এর জন্ম হয়েছিল অনেক আগেই।
আজ থেকে ১৩০ মিলিয়ন বছর আগে, আমাদের থেকে অনেক অনেক দূরের এক গ্যালাক্সিতে দুটি নিউট্রন নক্ষত্র পরস্পরের কাছাকাছি চলে এসেছিল। বেশ কিছুটা সময় তারা একে অপরকে সর্পিলাকারে আবর্তন করে, সজোরে আছড়ে পড়ে একটি আরেকটির উপর। অত্যন্ত শক্তিশালী এই সংঘর্ষে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নক্ষত্রের ভগ্ন অংশ। পাশাপাশি আরো ছড়ায় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এবং অতীব তীব্র আলোক রশ্মি। সূর্যের সাথে তুলনা করলে সে তীব্রতা হবে সূর্যের চেয়ে মিলিয়ন ট্রিলিয়ন গুণ বেশি। এতই তীব্র যে সেগুলো মিলিয়ন মিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরত্ব থেকেও দেখা যায়।
দুই নিউট্রন নক্ষত্রের সংঘর্ষের ফলে জন্ম নেয়া এসব তরঙ্গ যাত্রা শুরু করে পৃথিবীর দিকে। লক্ষ লক্ষ বছর ব্যাপী ভ্রমণ করতে থাকে পথ। করতে করতে ১৩০ মিলিয়ন বছর পার করে এসে পৌঁছায় পৃথিবীর বুকে। আর ঘটনাক্রমে এই সময়টাতেই বিজ্ঞানীরা তাক করে রেখেছিল টেলিস্কোপ সহ অন্যান্য শনাক্তকরণ যন্ত্র। আর তাক করার দিক ছিল ঠিক ঐ নক্ষত্রের দিকেই। বিজ্ঞানের কল্যাণে তাই আমরা এখানে বসে আজ থেকে দূরের ১৩০ মিলিয়ন বছর আগের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে পারছি।
এই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে এখানে স্বর্ণ জন্ম নিয়েছে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন এরকম সংঘর্ষের মাধ্যমে যে পরিস্থিতি তৈরি হয় তা স্বর্ণ ও প্লাটিনামের মতো মৌল তৈরির জন্য সকল শর্ত পূরণ করে।
স্বর্ণ তৈরি হয়েছে সুপারনোভা বিস্ফোরণ কিংবা ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষের ফলে; ছবি: Agora Economics
এ তো গেলো এক রহস্যের সমাধান। দূর নক্ষত্রের মিলনে স্বর্ণের জন্ম হয় ঠিক আছে, কিন্তু এভাবে জন্ম নেয়া স্বর্ণ পৃথিবী কিংবা অন্যান্য গ্রহে কীভাবে যায়? দুই মহাজাগতিক দানবের যখন সংঘর্ষ ঘটে তখন সেখান থেকে প্রচুর নাক্ষত্রিক উপাদান বাইরের দিকে ছিটকে পড়ে। সেসব ছিটকে যাওয়া পদার্থের সাথে স্বর্ণও থাকে। আবার এই সংঘর্ষের পর সুপারনোভার বিস্ফোরণ হলে তার উপাদান চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। সেসবের মাঝে স্বর্ণও আছে। এভাবে বিস্ফোরণের টুকরো টুকরো হয়ে গেলেই তার জীবনের সমাপ্তি ঘটে না। মূলত এর মাধ্যমে আরেকটি নতুন জীবনের সূচনা হয়।
এই ছিটকে যাওয়া অংশগুলো আবার মহাজাগতিক ধূলিমেঘের সাথে মিলে আরেকটি নতুন নক্ষত্র গঠনে কাজে লেগে যায়। নক্ষত্রের গঠন প্রক্রিয়ায় নক্ষত্রের সাথে গ্রহও তৈরি হয়, যেমন হয়েছিল সূর্যের পাশাপাশি সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহগুলো। ঐ যে সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল স্বর্ণগুলো সেগুলো তখন গ্রহ গঠনের সময় গ্রহের ভেতরে ঢুকে যায়। পৃথিবীতে আমরা যত স্বর্ণ দেখি তার সবই আসলে এসেছে এই দীর্ঘ আন্তঃনাক্ষত্রিক ধাপ পার হয়ে। তাই আমরা যখন নিজেদের হাতে কোনো স্বর্ণ দেখে তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবো তখন ভাবতে হবে, এই স্বর্ণ নিছকই কোনো ধাতু নয়। পৃথিবীর কোনো তাপ-চাপই এর কাছে কিছু নয়। কোটি কোটি বছর ধরে নক্ষত্রের চাপ এবং সংঘর্ষের অকল্পনীয় ধাক্কা পার হয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছে এই স্বর্ণ।
স্বর্ণ শুধু মামুলী অলংকার জাতীয় পদার্থ নয়, এর মাঝে লুকিয়ে আছে নক্ষত্রের গান। ছবি: thewallpaper.co
স্বর্ণকে অনেকেই মূল্যবান পদার্থ হিসেবে দেখে, কারণ এটি খুব দুর্লভ। কোনো বস্তু দুর্লভ হলে তার মূল্য বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে স্বর্ণকে সম্পদ হিসেবে তো দেখতে পারে সকলেই, তারাই তো অনন্য যারা স্বর্ণের ভেতরে নাক্ষত্রিক ও মহাজাগতিক কাব্যিকতা খুঁজে পায়।