মানুষ খর্বাকৃতি বা বামন হয় কেন?
Share
সাইন আপ করুন
লগিন করুন
Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.
Please briefly explain why you feel this question should be reported.
Please briefly explain why you feel this answer should be reported.
Please briefly explain why you feel this user should be reported.
‘হ্যারি পটার’ এর বামনদের কথা মনে আছে? কিংবা ‘তিন গোয়েন্দা’র রত্মদানোর কথা? শুধু গল্পে বা রূপকথাতেই নয়, বাস্তবেও হরহামেশাই দেখা মেলে খর্বাকৃতির কিছু লোকজনের। হয়তো আপনার পাশের বাসার বন্ধুটি আপনার সমবয়সী হওয়ার পরও আপনার তুলনায় যথেষ্ট খাটো। অথবা আপনার থেকে বয়সে বড় আপনার কাছের কোনো আত্মীয় এই অবস্থার শিকার। রাস্তায় বেরোলে এরকম মাথা বড়, অস্বাভাবিক খাটো লোকজনদের দেখে আমরা কখনো হাসি, কখনো ব্যঙ্গ করি, কটুক্তি ছুড়ে দিই, কখনোবা অবাক চোখে তাকাই। মানুষ হিসেবে মানবিক আচরণ করতে হয়তো ভুলে যাই ক্ষণিকের জন্য।
এরকম কোনো মানুষকে চোখে পড়লে তাদের প্রতি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ফাঁকে কখনো কি আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে যে, আপনার তুলনায় লক্ষ্যণীয় কম উচ্চতার এসব মানুষজনের খর্বাকৃতির হওয়ার কারণ কি? এই লেখাটিতে জানার চেষ্টা করব এই বিষয়েই।
বামনত্ব (Dwarfism) হলো একটি হরমোনঘটিত রোগ, যা মূলত দেহে বৃদ্ধি হরমোনের অভাবে হয়ে থাকে। বৃদ্ধি হরমোন হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের হরমোন, যা শরীরের সব ধরনের কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। এটি কোষ বিভাজনের মাত্রা বাড়িয়ে কোষকে সংখ্যায় এবং আকারে বৃদ্ধি করে। এই হরমোনের কারণেই মানুষ ছোট থেকে বড় হয়, মানুষের শরীর আকার-আয়তনে বৃদ্ধি পায়। কোনো কারণে যদি শরীরে পর্যাপ্ত বৃদ্ধি হরমোন উৎপন্ন হতে না পারে, তাহলে শরীরের বৃদ্ধি শ্লথ হয়ে আসে। এই সমস্যাটি সাধারণত শৈশবে শুরু হয় আর স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় বয়ঃসন্ধিকালে। তবে যেকোনো বয়সেই নানা কারণে বৃদ্ধি হরমোন কমে যেতে পারে এবং একজন ব্যক্তি বৃদ্ধি হরমোনঘটিত কোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
শৈশবেই বামনত্ব বোঝা যায়; Source: Gazette Live
বৃদ্ধি হরমোন আপনার মাথার পেছনে অবস্থিত পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। মহাগুরুত্বপূর্ণ এই পিটুইটারি গ্রন্থির আছে দুটো ভাগ- অগ্র পিটুইটারি এবং পশ্চাৎ পিটুইটারি। আমাদের আলোচ্য বৃদ্ধি হরমোন অগ্র পিটুইটারি থেকে ক্ষরিত হয়। অগ্র পিটুইটারি থেকে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের ক্ষরণ ঘটে থাকে। যেমন- এড্রেনোকর্টিকোট্রপিক হরমোন (ACTH), থাইরয়েড স্টিম্যুলেটিং হরমোন (TSH), ফলিকল স্টিম্যুলেটিং হরমোন (FSH) প্রভৃতি।
শরীরের বৃদ্ধি প্রক্রিয়া শুরু হয় মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে। অন্যভাবে বললে, বৃদ্ধি হরমোন নিঃসরণের ক্ষেত্রে হাইপোথ্যালামাসের বিশেষ ভূমিকা আছে। হাইপোথ্যালামাস থেকে Growth Hormone Stimulating Hormone ক্ষরিত হয়, যা অগ্র পিটুইটারিকে বৃদ্ধি হরমোন (Growth Hormone) নিঃসরণের জন্য উদ্দীপ্ত করে। ফলে বৃদ্ধি হরমোন নিঃসৃত হয়ে রক্তপ্রবাহে চলে আসে এবং যকৃতে পৌঁছে আরেকটি হরমোন Insulin like growth factor-1 ক্ষরণে উদ্দীপনা যোগায়। এই IGF-1 হরমোনটি প্রত্যক্ষভাবে হাড় এবং মাংসপেশীর বৃদ্ধি ঘটায়। বৃদ্ধির পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল বলে এই প্রক্রিয়ার যেকোনো ধাপে যেকোনো সমস্যা যথাযথ বৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে।
পিটুইটারি গ্রন্থি; Source: slideshare
বামনত্বের কারণ
বামনত্বের কারণ বড়ই বিচিত্র। বিভিন্ন কারণেই এটি হতে পারে। যেমন-
আরো অজানা (Idiopathic) নানা কারণে বামনত্ব হতে পারে।
বামনত্বের কারণ বিভিন্ন হতে পারে; Source: Starcasm
বামনত্বের প্রকারভেদ
উপসর্গ, বৃদ্ধির ধরন, শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা, রোগের কারণ প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা করে বামনত্বকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-
প্যানহাইড্রোপিটুইটারিজ
পিটুইটারি থেকে ক্ষরিত বেশিরভাগ হরমোনই অগ্র পিটুইটারি থেকে আসে। কয়েকটির নামও উল্লেখ করা হয়েছে উপরে। কোনো কারণে যদি পিটুইটারি গ্রন্থি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাহলে শুধু বৃদ্ধি হরমোনই নয়,অগ্র পিটুইটারি থেকে ক্ষরিত সব হরমোনেরই অভাব দেখা যায়। ফলে শরীরের বৃদ্ধি হ্রাস পায়। উচ্চতা কম হয়, হাত-পা, বাহু শরীরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ছোট হয়। কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আশানুরুপ বাড়তে পারে না, নির্দিষ্ট কাজের উপযোগী হতে পারে না। এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের বয়ঃসন্ধি দেরিতে হয়। প্রজনন অঙ্গগুলো পরিণত না হওয়ার কারণে ব্যক্তি বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। মাথায় বড় ধরনের কোনো আঘাত লাগলে কিংবা পিটুইটারি গ্রন্থিতে টিউমার হলে এই রোগ হতে পারে।
বৃদ্ধি হরমোনের অভাবজনিত বামনত্ব
এই রোগ হয় শরীরে শুধুমাত্র বৃদ্ধি হরমোনের অভাব থাকলে। বৃদ্ধি হরমোন যথেষ্ট পরিমাণে থাকে না বলে আক্রান্ত ব্যক্তি উচ্চতায় বাড়ে না। অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আকারও ছোট হয়। তবে এরা প্রজননে সক্ষম হয়ে থাকে।
লেভিলরেন বামনত্ব
শরীরে যদি বৃদ্ধি হরমোনের জোয়ারও বয়ে যায়, তবু এটি কাজ করতে পারবে না যদি সোমাটোমেডিন সি (IGF-1) এর অভাব থাকে। লেভিলরেন বামনদের শরীরে যথেষ্ট গ্রোথ হরমোন থাকে, তবে থাকে না IGF-1। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়, গ্রোথ হরমোন শরীরের সব জায়গায় পৌঁছে যায় ঠিকই, তবে শরীর তা কাজে লাগাতে পারে না। ফলে বৃদ্ধি হ্রাস পায়। পৃথিবীর সবচেয়ে খর্বাকার আফ্রিকার পিগমি আদিবাসীরা এই শ্রেণীর বামন।
কোনো কোনো বামনত্বের ক্ষেত্রে শরীরের সব অঙ্গ একই অনুপাতে বাড়ে। মাথা, হাত-পা সবকিছুরই বৃদ্ধি রহিত হয়। সবগুলো অঙ্গই ছোট হয়। আবার কখনো দেখা যায়, শরীর ঠিকঠাক বাড়ছে কিন্তু হাত-পা ছোট, মাথা বড়।
কীভাবে বুঝবেন আপনার শিশু বামনত্ব রোগে ভুগছে কিনা?
স্বাভাবিক বাচ্চাদের থেকে বৃদ্ধি হরমোনের ঘাটতি থাকা বাচ্চারা সাধারণত ২০-২৫ শতাংশ কম বাড়ে। ২-৪ বছর বয়সেই ব্যাপারটি বোঝা যায়। হাত-পা অতিরিক্ত খাটো হয়। মুখমণ্ডল ছোট হয়, কারণ মুখমণ্ডলের হাড় ম্যাক্সিলা ও ম্যান্ডিবল তেমন একটা বাড়ে না। দাঁতগুলোও পরিপক্ক হয় না। নাক ছোট হয়, চোখ দুটো কাছাকাছি মনে হয়। শরীরে প্রোটিন উৎপাদন কম হওয়ায় মাংসপেশী কম তৈরি হয়। শরীরে অস্বাভাবিক চর্বি জমতে দেখা যায়। প্রজনন অঙ্গ সুগঠিত হয় না। চামড়া কুঁচকানো হতে পারে। বুদ্ধিমত্তা সাধারণত স্বাভাবিকই থাকে। তবে বিষন্নতা, হীনমন্যতার মতো মানসিক জটিলতা কাজ করতে পারে।
বামনত্বে আক্রান্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ; Source: thinglink
আপনার বাচ্চার মধ্যে উপরের লক্ষণগুলো যদি দেখা যায়, তাহলে কি সে আসলেই বামনত্বে ভুগছে? ভাবছেন, এটি নিশ্চত হবেন কীভাবে? কিছু কিছু পরীক্ষা আছে, যেগুলো করলে বোঝা সম্ভব আপনার বাচ্চা সত্যিই বামনত্বে ভুগছে কিনা। হাতের মুষ্টির এক্স-রে তার মধ্যে একটি। এই এক্স-রে করলে হাতের হাড়ের বয়স (Bone Age) নির্ণয় করা যায়। হাড়ের বয়স এবং বাচ্চার বয়সের তুলনা করে বোঝা যায় শিশুর বামনত্ব আছে কিনা। সাধারণত বামনত্বে আক্রান্ত বাচ্চাদের হাড়ের বয়স মূল বয়সের চেয়ে দু’বছর কম হয়। যেমন- বাচ্চার বয়স ১০ বছর হলে হাড়ের বয়স হবে ৮ বছর।
বামনত্বের প্রতিকার
বৃদ্ধি হরমোন ইনজেকশন; Source: perimeter institute
বয়সের তুলনায় অল্প বাড়া শিশুদের যদি অল্প বয়সে ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্রোথ হরমোনের ডোজ দেওয়া হয়, তাহলে বামনত্ব সেরে যায়। শিশুটি স্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। অনেকেই জানেন নিশ্চয়ই, জনপ্রিয় ফুটবল তারকা লিওনেল মেসিকেও বৃদ্ধি হরমোনের অভাব সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগতে হয়েছিল। ছোটবেলায় যখন তার রোগটি ধরা পড়ে, তখন তার উচ্চতা ছিল ৪ ফুট ২ ইঞ্চি। তারপর বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের আলোচিত চিকিৎসার পর তার বর্তমান উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি, যা গড়পড়তা আর্জেন্টাইনদের চেয়েও বেশি!
আগে মৃতদেহ থেকে বৃদ্ধি হরমোন সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু এতে ভয়ানক একটি রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকায় আর এভাবে বৃদ্ধি হরমোন সংগ্রহ করা হয় না। এখন রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া কোষ থেকে বৃদ্ধি হরমোন উৎপাদন করা হয়। এছাড়া কিছু কিছু ওষুধ আছে, যেগুলো গ্রহণ করলে শরীরের অভ্যন্তরেই বৃদ্ধি হরমোন উৎপাদন বাড়ে।
লিওনেল মেসি; Source: ESPN
আপনার শিশু যদি বামনত্বে আক্রান্ত হয়েই থাকে, তাহলে ভয় পাবেন না। যথাযথ চিকিৎসায় বামনত্ব ভাল হতেও পারে। আর আপনার চারপাশের খর্বাকার লোকদের প্রতি খারাপ আচরণ করবেন না। তাদের এই অবস্থার পেছনে তারা কোনভাবেই দায়ী নন, তারা একটি রোগের শিকার মাত্র।