কীটপতঙ্গদের কেনো ধন্যবাদ জানাবেন?
শেয়ার করুন
সাইন আপ করুন
লগিন করুন
পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? আপনার ইমেইল এড্রেস দিন। ইমেইলের মাধ্যমে আপনি নতুন পাসওয়ার্ড তৈরির লিংক পেয়ে যাবেন।
আপনি কেন মনে করছেন এই প্রশ্নটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই উত্তরটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই ব্যক্তিকে রিপোর্ট করা উচিৎ?
সাধারণ মানুষের কাছে কীটপতঙ্গ কোনো পছন্দনীয় প্রাণী নয়। মানুষমাত্রই কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় এসব থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা করে। এই অপছন্দের কারণ কিন্তু খুব বেশি অযৌক্তিক নয়। ফসলে বা উপকারী উদ্ভিদের উপর পোকামাকড় আক্রমণ করে সেগুলোকে নষ্ট করে ফেলে, যে কারণে অনেক সময় মানবজাতির খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এসব পোকামাকড়কে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় পেস্ট (Pest)। আবার অনেক পোকামাকড় মানুষের ভিতর নিজেদের রোগজীবাণু ছড়িয়ে দেয়, যা অনেক সময় তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এছাড়া কামড় দেয়া, শরীরের উপর বসে জীবাণু ছড়ানো ইত্যাদি বিভিন্ন কারণ তো আছেই। তাই নিজে থেকে কোনো সাধারণ মানুষ পোকামাকড়কে পছন্দ করবে সেটা ভাবা বোকামি। অথচ এই পোকামাকড় না থাকলে প্রকৃতিতে ভারসাম্য কিন্তু বজায় থাকতো না!
পোকামাকড় না থাকলে হয়তো পৃথিবীতে প্রাণীরা টিকে থাকতে পারতো না; Image Source: AnimalSake
প্রকৃতির এক অনবদ্য দান হচ্ছে এই কীটপতঙ্গ। প্রকৃতির সৃষ্ট কোনো কিছুই অকারণে সৃষ্টি হয় না। তার পেছনে ভারসাম্যতা বজায় রাখার একটা ব্যাপার কাজ করে। প্রকৃতিতে প্রাণীকুলের মধ্যে মানুষ আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছে, কিন্তু মানুষের সাথে সাথে আরও যে যে প্রাণীকুল দেখতে পাওয়া যায় সেগুলোকে কি এমনি এমনি সৃষ্টি করা হয়েছে? এই প্রাণীদের কাজ কি শুধু মানুষের ক্ষতি করে বেড়ানো?
প্রত্যেকটি জীবের ভালো এবং খারাপ- দুটি দিকই আছে। তাই শুধু মাত্র ক্ষতি করার জন্যই যে পোকামাকড়ের সৃষ্টি হয়েছে সেটা ভেবে নেয়াটা ভুল। অথচ মানবজাতি তথা পুরো বিশ্বকে টিকিয়ে রাখতে এবং প্রকৃতিতে টিকে থাকতে এই কীটপতঙ্গের অবদান অপরিসীম। কম-বেশি আমরা সবাই প্রকৃতিতে কীটপতঙ্গের অবদান সম্পর্কে জানি। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমরা কতটুকু অনুভব করেছি সেটা ভেবে দেখার বিষয়। আমরা যদি সত্যিই ব্যাপারটি অনুভব করতে পারি তাহলে আমরা পোকামাকড়দের ধন্যবাদ দিতে কখনোই পিছপা হবো না।
পরাগায়ন প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকলাপ। পরাগায়নের মাধ্যমে একই উদ্ভিদ তাদের ফুলের রেণুর মাধ্যমে আরও একটি জায়গায় একই প্রজাতির উদ্ভিদ উৎপন্ন করতে পারে। উদ্ভিদগুলোর প্রজাতি একই রকম হয়ে থাকে। এই পরাগায়নটা হয় কীটপতঙ্গের মাধ্যমে। যখন কীটপতঙ্গগুলো কোনো প্রজাতির উদ্ভিদ ফুলের উপর বসে তখন সেটার রেণু সেই পতঙ্গের গায়ে লেগে যায় এবং এই পতঙ্গ যখন একই প্রজাতির আরেকটি উদ্ভিদের উপর বসে তখন সেখানে পতঙ্গ থেকে সেই রেণু লেগে যায় এবং পরাগায়ন শুরু হয়। এই পরাগায়ন উদ্ভিদজগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দান। বিভিন্ন ধরনের Monarch Butterfly, যেমন- মৌমাছি এবং এরকম আরও কীটপতঙ্গ এই পরাগায়নে সাহায্য করে।
প্রকৃতির এক অনবদ্য দান হচ্ছে এই কীটপতঙ্গ; Image Source: Canadian Geographic
মাদাগাস্কার দ্বীপে একধরনের অর্কিড পাওয়া যায়। এই অর্কিডের পরাগায়ন সম্ভব একধরনের মথের সাহায্যে। এই বিশেষ ধরনের মথ ছাড়া কোনোভাবেই এই অর্কিডের পরাগায়ন সম্ভব নয়। মথ নিজেও একধরনের পোকা। চার্লস ডারউইন প্রথম এই বিশেষ ধরনের অর্কিডের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারেন।
আবার এমন কিছু কিছু পোকা আছে যেগুলো অন্য পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে, যেমন- Plant Mantis। এই প্রজাতির পোকা বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে এবং বংশবৃদ্ধি করে। এই ক্ষতিকর পোকামাকড়গুলো আবার আমাদের ফসলের ক্ষতি করে। তাই প্রকৃতি নিজে থেকেই এই Plant Mantis সৃষ্টি করেছে যেটা Pest Control Service হিসেবে কাজ করে এবং যে নিজেই ক্ষতিকর প্রাণীগুলোকে শেষ করে দিচ্ছে, আর তাতে আমাদের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। এই Plant Mantis এর মধ্যে একধরনের জাত আছে যাকে বলে শিকারি ম্যানটিস (Praying Mantis)। এই জাতটি পেস্ট জাতীয় পোকামাকড়গুলোকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, যে কারণে এসব ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সংখ্যা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
পরাগায়ন উদ্ভিদজগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দান; Image Source: Living in the environment/ John Henry Williams-Bruce Coleman USA
কিছু কিছু পোকামাকড় আবার জৈব যৌগ ভেঙে ফেলতে পারে। যারা জাদুঘরে কাজ করে তারা পোকামাকড়ের এই গুণটি তাদের নিজেদের কাজে ব্যবহার করে। জাদুঘরে পুরনো স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কঙ্কাল দেখতে পাওয়া যায়। এই কঙ্কালগুলোকে পরিষ্কার করার জন্য তারা একটি বিশেষ ধরনের গুবরেপোকা ব্যবহার করে যেটা পশম জাতীয় জিনিসে জন্মায় এবং সেখানেই নিজস্ব কলোনি তৈরি করে। এই পোকাগুলো জৈব যৌগ, পশম, গালিচা ইত্যাদি খেয়ে ফেলতে পারে।
আবার কিছু কিছু পোকামাকড় আছে যারা মাটির নিচে থাকে এবং মাটিকে উর্বর রাখতে এবং নরম রাখতে সহায়তা করে। এই উর্বরতা বৃদ্ধির কারণে গাছপালা সহজে জন্মাতে পারে, যা প্রকৃতির টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন।
৪০০ মিলিয়ন বছর আগে এই পৃথিবীতে পোকামাকড়ের জন্ম হয়; Image Source: Geographical magazine
৪০০ মিলিয়ন বছর আগে এই পৃথিবীতে পোকামাকড়ের জন্ম হয়। অর্থাৎ মানুষের বর্তমান যে অবস্থা তার থেকে প্রায় ২,০০০ গুণ বেশি বছর আগে থেকে কীটপতঙ্গ-পোকামাকড়দের আনাগোনা পৃথিবীতে শুরু হয়। মানুষের থেকে বুদ্ধি এবং প্রজাতিগত উন্নতিতে পিছিয়ে থাকলেও কীটপতঙ্গ যুগ যুগ ধরে নিজেদেরকে প্রকৃতিতে খুব সফলতার সাথে টিকিয়ে রাখছে। তারা খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে। আশেপাশের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলার জন্য নিজেদের ভিতর নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তৈরি করে নিতে পারে।
কিছু কিছু পোকামাকড় প্রকৃতিতে সফলভাবে টিকে থাকার জন্য নিজেদের প্রজাতি পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। প্রকৃতিতে এরকম বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এরকম বৈশিষ্ট্য খুব বেশি প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না। প্রাণীবিদরা এই বৈশিষ্ট্য প্রকৃতিতে সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছে বলে মনে করছেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড উইলসন, যিনি একাধারে একজন পিঁপড়া বিশেষজ্ঞ এবং জীববৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞ, বলেন যে, যদি পৃথিবীর সব ধরনের পোকামাকড়-কীটপতঙ্গ নিঃশেষ হয়ে যায় তাহলে এই পুরো পৃথিবীর প্রাণীকূল ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। পৃথিবীতে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব না-ও থাকতে পারে এবং এতে অন্যান্য প্রজাতির প্রাণীদেরও টিকে থাকতে সমস্যা হবে।
Plant Mantis – এই প্রজাতির পোকা বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে; Image Source: Living in the environment/ Peter J. Bryant_Biological Photo Service
বিজ্ঞানীরা কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় ইত্যাদি সংরক্ষণ করার জন্য অনেক ধরনের গবেষণা করছেন। বিখ্যাত একটি জার্নাল আছে, নাম Journal of Insect Conservation। এই জার্নালটিতে প্রতিবছর প্রকৃতি বিশেষজ্ঞরা পরিবেশে পোকামাকড়ের অবদান নিয়ে তাদের গবেষণাপত্র প্রকাশ করে থাকেন। এগুলোর মধ্যে কিছু গবেষণাপত্র সম্পূর্ণ তাত্ত্বিক এবং কিছু ব্যবহারিক। খুবই হাই ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নাল এটি। অমেরুদণ্ডী প্রাণীদেরকে নিয়েই মূলত লিখতে হয় এই জার্নালটিতে। পোকামাকড়ের শ্রেণীকরণ, তাদের অভ্যাস এবং ব্যবহার, বংশপরম্পরা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে এই জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়ে থাকে।