নদীগুলো আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত হয় কেন ?
শেয়ার করুন
সাইন আপ করুন
লগিন করুন
পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? আপনার ইমেইল এড্রেস দিন। ইমেইলের মাধ্যমে আপনি নতুন পাসওয়ার্ড তৈরির লিংক পেয়ে যাবেন।
আপনি কেন মনে করছেন এই প্রশ্নটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই উত্তরটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই ব্যক্তিকে রিপোর্ট করা উচিৎ?
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি নদী আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত হয়ে আসছে। এমন কোনো নদী নেই যেটা সোজা পথে প্রবাহিত হচ্ছে। বিজ্ঞানের ভাষায় নদীর এই সর্পিল পথকে Meandering বলা হয়ে থাকে। মাটি থেকে অনেক উপর থেকে বিশেষ করে বিমান কিংবা পাহাড়ের উপর থেকে নিচের দিকে খেয়াল করলে নদীর এই সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া সহজেই বোঝা যায়। মাঝে মাঝে নদীর কোনো কোনো অংশ সোজা দেখা যায়। কিন্তু সেই সোজা অংশটিও সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার বাঁকা পথ ধরে প্রবাহিত হতে থাকে। মাঝে মাঝে কিছু কিছু নদী এত তীব্রভাবে বেঁকে যায় যে নদীর প্রবাহ পথ থেকে অনেক সময় এই বাঁকা অংশ আলাদা হয়ে যায়। এই আলাদা হয়ে যাওয়া অংশকে বলা হয় Oxbow। এই অংশগুলোকে নদীর সর্পিল পথের পাশেই স্থান নিতে দেখা যায়। পৃথিবীর কম বেশি প্রায় প্রত্যেকটি নদীর পাশে Oxbow দেখা যায়।
খুব স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন এখানে চলে আসে, কেন নদীগুলো সোজা প্রবাহিত না হয়ে এঁকেবেঁকে নিজের গতিপথ নির্ধারণ করে? নদীর প্রবাহ পথের এরকম প্যাটার্ন কি নিছক সম্ভাবনা নাকি প্রাকৃতিক কোনো কারণ রয়েছে? যদি প্রাকৃতিক কারণ হয় তাহলে এর পেছনে কোন কোন বৈশিষ্ট্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে? আজকের এই লেখায় এই প্রশ্নগুলোর বৈজ্ঞানিক উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা হবে।
Meandering এবং Oxbow lake এর সমাবেশ; Image Source: Pinterest
নদীর উৎপত্তি হবার পর নদীটি যে বেঁকে যাবে সেটা অনেকটাই নির্ধারিত। কিন্তু এই বেঁকে যাবার শুরুটা ঘটে দৈবক্রমে। নদী তার উৎপত্তির পরপর যেভাবে প্রবাহিত হয়ে বেঁকে যায় সেই গতির ব্যাখ্যা দেয়া খুবই জটিল। কারণ প্রক্রিয়াটির সাথে সম্ভাব্যতা (Probability) জড়িত থাকে। তরল গতিবিদ্যা (Fluid Dynamics) দিয়ে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু এ ব্যাপারে ভিন্ন মত রয়েছে [১]।
নদীর প্রবল স্রোত নদীর দুই তীরের নদীমাটির ক্ষয় সাধন করে। নদীর দিক পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া খুবই জটিল; Image Source: wyza.com.au
নদীর প্রবল স্রোত এবং প্রবাহ বলের কারণে একবার যদি দিক পরিবর্তন শুরু হয় তাহলে সেই পরিবর্তনের হার খুবই দ্রুত হবে এটা ধরে নেয়া যায়। নদীর স্রোতের প্রবাহের এই পরিবর্তনের জন্য নদীর দুই তীরের মাটির ক্ষয়সাধন (Soil Erosion) হয়। নদীর দিক পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া খুবই জটিল এবং বিশেষ বিশেষ কিছু অবস্থার উপর নির্ভর করে। পদার্থবিজ্ঞানে খুব সহজ করে এই প্রক্রিয়ার একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ব্যাখ্যাটি এরকম-
স্রোতের কারণে বেঁকে যাওয়া শুরুর প্রক্রিয়া বেশ জটিল। তবে একবার বেঁকে যাওয়ার পর, তা যত অল্পই হোক না কেন, নদীর পানি যখন এই বাঁকের মধ্যে প্রবেশ করে তখন পানির এই প্রবাহের উপর এক ধরনের বল কাজ করে যা পানির স্রোতকে বাইরের দিকে ঠেলে দিতে চায়। কখনো দোলনায় চড়লে খেয়াল করে দেখবেন, দোলনার ঘূর্ণনের সময় একটি বল আমাদেরকে বাইরে ঠেলে নিয়ে যেতে চায়- বিষয়টা অনেকটা এরকম। কিন্তু নদীর তীর এবং নদীর আশেপাশের মাটির কারণে পানি তীরের বাইরে চলে যেতে পারে না। কারণ নদীর পানি এবং তীরের মাটিগুলোর মধ্যে একধরনের ঘর্ষণ বল কাজ করে যা স্রোতকে বাইরে ঠেলতে বাধা দেয়। এই অবস্থায় নদীতে একধরনের প্রবাহ সৃষ্টি হয়, যা নদীর এক তীর থেকে আরেক তীরের দিকে প্রবাহমান হয়। এই প্রবাহকে Secondary Flow বলে [২]।
Image Source: Colorado.com
Secondary Flow কী সেটা পরিষ্কারভাবে এবং সহজ করে বুঝতে হলে চায়ের কাপে চামচ দিয়ে নাড়ানোর উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। চামচ দিয়ে যখন চায়ের কাপের চারদিকে আমরা নাড়াতে থাকি তখন কাপের ভিতরে চায়ের মিশ্রণের আচরণের দিকে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, কাপের মাঝ বরাবর একটি ঘূর্ণন সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘূর্ণনটি হয় কাপের উপরের দিকেই। নিচের দিকে এই ঘূর্ণন অনেক কম হয় কারণ কাপের তলানির সাথে এবং পাশের দেয়ালের সাথে ঘর্ষণের ফলে ঘূর্ণনের গতি কমে যায়।
কাপের উপরে এবং নিচের দিকের ঘূর্ণনের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের জন্য উপর থেকে নিচের দিকে তরল চা প্রবাহিত হয়। চামচ দিয়ে ঘোরানোর ফলে প্রথমে ঘূর্ণন গতি বাইরের দিকে একটি বল অনুভব করবে, যে কারণে প্রবাহটি চায়ের উপরের পৃষ্ঠ বরাবর প্রথমে দেয়ালের দিকে যাবে। এরপর দেয়াল বরাবর নিচের দিকে গিয়ে কাপের তলানি বরাবর চারদিকে একবার ঘূর্ণন হবে এবং এই ঘূর্ণন কাপের মাঝ বরাবর উপরের দিকে উঠে যাবে। এই পুরো প্রবাহকে Secondary Flow বলা হয়ে থাকে। চায়ের উপরের দিকে মাঝখানে আমরা যে ঘূর্ণন দেখি, সেটা এই প্রক্রিয়াতেই তৈরি হয়।
আমাজন বনে সৃষ্ট নদীর Meandering; Image Source: Pinterest
নদী বেঁকে যাবার পর দুই তীরের মধ্যবর্তী এবং নদীর মাঝামাঝি জায়গায়ও একই প্রক্রিয়া ঘটে। পানির প্রচণ্ড স্রোত যখন বাঁকের ভিতর প্রবেশ করে তখন চায়ের কাপের ভিতরের অবস্থার অনুরূপ একটা ঘূর্ণন গতির সৃষ্টি হয়, যার দরুন নদীর স্রোতের কিছু অংশ নদীর বাহিরের দিকের তীর (Outer Bank) পর্যন্ত প্রবাহিত হয় এবং সেখান থেকে নদীর তীর ঘেঁষে নিচের দিকে গিয়ে নদীর তলার (River Bed) সাথে সমান্তরালে প্রবাহিত হতে থাকে। সেখান থেকে নদীর অপর পাশের ভিতরের দিকের তীর (Inner Bank) বরাবর উপরের দিকে উঠে যায়। পুরো প্রক্রিয়াটি সেকেন্ডারি ফ্লোয়ের কারণে হয়।
সেকেন্ডারি ফ্লো মেকানিজম; Image Source: Hindered Settling Blog
এই প্রবাহের কারণে নদীর বাইরের দিকের তীর ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কারণে নদীর মাটি কণাগুলো আলাদা হয়ে যায়। আলাদা মাটির কণাগুলো সেকেন্ডারি ফ্লোয়ের কারণে যে প্রবাহের সৃষ্টি হয় তার দিক বরাবর নদীর পানির সাথে প্রবাহিত হতে থাকে। এভাবে পানির সাথে বহমান মাটির কণাগুলো তলানি হিসেবে কিছু নদীর পানির নিচে এবং কিছু নদীর ভিতরের দিকের তীরে গিয়ে জমা হয়। এভাবে বাইরের তীর থেকে মাটি সরে গিয়ে অপর তীর ক্ষতিগ্রস্থ করে। যে দিকের মাটি সরে যায় সেই দিক বরাবর নদীগুলো বেঁকে যেতে থাকে। একইভাবে নদীর দিক পরিবর্তন হয়ে নদীগুলো সর্পিল আকারে প্রবাহিত হতে থাকে। কোনো কোনো সময় অতিরিক্ত স্রোতের কারণে কিংবা মাটির গঠনের কারণে এই বাঁকগুলো অনেক দীর্ঘ এবং ঘন হতে পারে।
নদীর এই বাঁকগুলো যখন একদিক থেকে গিয়ে আরেক দিকে আবারও বেঁকে যায় অর্থাৎ একটি লুপ তৈরি করে তখন কিছু কিছু নদীর ক্ষেত্রে এই বাঁকগুলো লুপ সহ আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে গিয়ে এরা নদীর এক পাশেই অবস্থান করে। এ ধরনের লুপকে বলা হয় Oxbow Lake; Image Source: thoughtco.com
নদীর এই বাঁকগুলো যখন একদিক থেকে অন্য দিকে আবারও বেঁকে যায় অর্থাৎ একটি লুপ তৈরি করে, তখন কিছু কিছু নদীর ক্ষেত্রে এই বাঁকগুলো লুপ সহ আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে গিয়ে এরা নদীর এক পাশেই অবস্থান করে। এই ধরনের লুপকে বলা হয় Oxbow Lake, যেটা সম্পর্কে আগেই একটু বলা হয়েছিল। এটি দেখতে অনেকটা U আকৃতির হয়ে থাকে। এখানে পানি প্রবাহ থাকে না। পুকুরের মতো স্থির পানি দিয়ে ভরা থাকে। বিভিন্ন জায়গায় কৃত্রিমভাবে Oxbow Lake তৈরি করা হয়। জার্মানির রাইন নদী থেকে একবার এরকম Oxbow Lake তৈরি করা হয়েছিলো। এর ফলে সেই নদী পথে চলাচল করার জন্য সোজা পথ তৈরি হয়।