পৃথিবীটা যদি সমতল হতো তাহলে কেমন হতো?
শেয়ার করুন
সাইন আপ করুন
লগিন করুন
পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? আপনার ইমেইল এড্রেস দিন। ইমেইলের মাধ্যমে আপনি নতুন পাসওয়ার্ড তৈরির লিংক পেয়ে যাবেন।
আপনি কেন মনে করছেন এই প্রশ্নটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই উত্তরটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই ব্যক্তিকে রিপোর্ট করা উচিৎ?
কেমন হতো যদি আমাদের পৃথিবীটা বর্তুলাকার না হয়ে সমতল চাকতির মতো হতো? যেরকমটি ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটির সদস্যরা বিশ্বাস করে থাকে? আমাদের জীবনে এই সমতল চাকতির মতো পৃথিবীর প্রভাব কীরকম হতো? আমরা যদি হাঁটতে হাঁটতে সেই চাকতির একেবারে প্রান্তে পৌঁছে যেতাম, তাহলে কি সেখান থেকে বাইরের মহাশূন্যে ছিটকে পড়ে যেতাম?
পৃথিবী বা অন্য কোনো গ্রহের পক্ষেই আসলে সমতল হওয়া সম্ভব না। মহাকর্ষ শক্তির প্রভাবেই গ্রহ-নক্ষত্রগুলো প্রায় বৃত্তাকার হতে বাধ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গ্রহ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভ স্টিভেনসনের মতে, এই মুহূর্তে যদি পৃথিবীকে জোর করে প্যানকেকের মতো সমতল করে দেওয়া হয়, তাহলে যা ঘটবে তা হচ্ছে, মহাকর্ষীয় বলের প্রভাবে এটি আবার গোলকে রূপান্তরিত হওয়ার চেষ্টা করবে। সমতল বানিয়ে ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথেই পৃথিবী এত প্রবলভাবে গোলক রূপে ফিরে যেতে চাইবে যে, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এমন কোনো পদার্থ নেই, যা দিয়ে পৃথিবীর পুনরায় গোলকে রূপান্তরিত হওয়ার প্রচেষ্টা ঠেকিয়ে রাখা যাবে। তার মতে, মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই পৃথিবী গোলকে রূপান্তরিত হতে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে।
সমতল পৃথিবীর প্রান্ত থেকে বাইরে পড়ে যাওয়ার ধারণা @ Antar Dayal / Getty
লন্ডনের রয়্যাল অবজারভেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী ম্যারেক কুকুলাও স্টিভেনসনের মতো একই ধারণা পোষণ করেন। তার মতে, পৃথিবীকে যদি সমতল অবস্থায় রাখতে হয়, তাহলে এমন একটি সুইচের প্রয়োজন হবে, যার মাধ্যমে মহাকর্ষকে গায়েব করে দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডল বলে কিছু থাকবে না; বায়ুমণ্ডল সহ পৃথিবীর সাথে স্থায়ীভাবে সংযুক্ত নয়, এমন সব কিছুই ভাসতে ভাসতে মহাশূন্যে উড়ে যাবে। তাছাড়া বায়ুমণ্ডল না থাকায় অক্সিজেনের অভাবে সেখানে কোনো প্রাণীর পক্ষে বেঁচে থাকাও সম্ভব হবে না।
কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে, কোনো অলৌকিক ক্ষমতা বলে পৃথিবীকে সমতল করে ফেলা হলো এবং এর আকর্ষণ শক্তিও বজায় রাখা হলো, সেক্ষেত্রে কী ঘটতে পারে?
মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রকৃতি
গোলাকার পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দিক; Source: TheHUB
সমতল পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দিক; Source: TheHUB
সমতল পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কেন্দ্র হবে চাকতিটির পৃষ্ঠের কেন্দ্রবিন্দুতে। ফলে আপনি যদি চাকতির মতো আকৃতি বিশিষ্ট পৃথিবী পৃষ্ঠের কেন্দ্রে বা এর আশেপাশে অবস্থান করেন, তাহলে অনেকটা এখনকার মতোই আকর্ষণ অনুভব করবেন। কিন্তু কেন্দ্র থেকে যত দূরে যেতে থাকবেন, পৃথিবী সমতল হওয়ার কারণে মাধ্যাকর্ষণ বল আপনাকে তত তীর্যকভাবে আকর্ষণ করতে থাকবে। ফলে আপনার হাঁটতে কষ্ট হবে এবং মনে হবে, আপনি বুঝি ঢালু পথ বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছেন। কেন্দ্র থেকে যত বেশি প্রান্তের দিকে যেতে থাকবেন, আপনার কাছে ঘর-বাড়ি, পাহাড়-পর্বত সব কিছুকে তীর্যকভাবে তৈরি বলে মনে হতে থাকবে।
পৃথিবী পৃষ্ঠের পুরুত্বের উপর নির্ভর করে কেন্দ্রের দিকে অভিকর্ষের মান মোটামুটি স্বাভাবিক হতে পারে। চাকতিটির পুরুত্ব কীরকম হতে পারে, সেটি নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। তবে এর পুরুত্ব বর্তমান পৃথিবীর ব্যাসার্ধের এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ প্রায় ২,১২৩ কিলোমিটার ধরে নেওয়া যায়। এর কারণ হচ্ছে, গোলকের পৃষ্ঠকে যদি ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ব্যাসার্ধের এক-তৃতীয়াংশ পুরুত্ব নিলেই কেবল গোলকের সমান আয়তন পাওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর কেন্দ্র অভিকর্ষের মান বর্তমানের তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হতে পারে। তবে কেন্দ্র থেকে দূরে যেতে থাকলে এই মান ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকবে।
পৃথিবীর প্রান্ত থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়া
পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে দূরে যেতে থাকলে পথগুলোকে ঢালু মনে হবে; Source: VSauce/YouTube
পৃথিবীর একেবারে প্রান্তে পৌঁছানো আপনার পক্ষে অসম্ভব না হলেও খুবই কঠিন একটি কাজ হবে। কারণ, একেবারে প্রান্তে পৃথিবীর অভিকর্ষ বল প্রায় ভূমির সমান্তরালে কাজ করবে। ফলে আপনি যদি প্রান্তের কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করেন, তাহলে আপনার কাছে মনে হবে, আপনি বুঝি একেবারে খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন।
যদি কোনোভাবে আপনি পৃথিবী নামক চাকতিটির একেবারে প্রান্তে পৌঁছে যেতে পারেন, তাহলে আপনি তো বাইরের মহাশূন্যে ছিটকে পড়বেনই না, বরং সম্ভাবনা আছে কেন্দ্রের দিক থেকে ভূমির সমান্তরাল আকর্ষণ শক্তির প্রভাবে আপনি ভেতরের দিকেই পড়ে যাবেন। আর একবার যদি চাকতির প্রান্তের ধারের উপর উঠে যেতে পারেন, তাহলে আপনার কাছে সেটিকেই স্বাভাবিক মাটি বলে হবে। সেখানে আপনি খুবই স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারবেন, অনেকটা এখনকার মতোই।
পৃথিবীর প্রান্তে পৌঁছালে ভেতর দিকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে; Source: VSauce/YouTube
দিবারাত্রির পরিবর্তন
পৃথিবী গোলক হওয়ায় নিজ অক্ষের উপর আবর্তের ফলে দিবারাত্রি সংঘটিত হয়। কিন্তু পৃথিবী যদি সমতল হয়, তাহলে দিন বা রাত বলে পৃথক কিছু থাকবে না। সবসময় সমগ্র পৃথিবী একই রকমের আলো পাবে। অবশ্য আমরা যদি কল্পনা করে নেই যে, পৃথিবী না, বরং সূর্যই পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে, সেক্ষেত্রে অবশ্য ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে দিন এবং রাত সংঘটিত হবে ঠিকই, কিন্তু সমগ্র পৃথিবীতে একই সাথে দিন হবে, আবার একই সাথে রাত হবে।
ঋতু পরিবর্তন
পৃথিবী তার অক্ষের উপর তীর্যকভাবে হেলে থাকা অবস্থায় সূর্যের চারদিকে আবর্তন করার ফলে দিবারাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে এবং ঋতু পরিবর্তিত হয়। কিন্তু পৃথিবী সমতল হলে ঋতুর কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। পুরো বছর জুড়ে পৃথিবীর সকল স্থান একই রকম সূর্যের আলো পাবে। ফলে গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল বা শীতকাল বলে পৃথক পৃথক কোনো ঋতু থাকবে না। সমগ্র পৃথিবীর তাপমাত্রা মোটামুটি একই রকম থাকবে। উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু নামে কিছু না থাকায় কোথাও কোনো বরফও থাকবে না।
সাগর-মহাসাগরের অবস্থান
গোলাকার পৃথিবী বনাম সমতল পৃথিবী; Source: TheHUB/ Youtube
যেহেতু পৃথিবী নামক চাকতিটি সবকিছুকে তার কেন্দ্র বরাবর আকর্ষণ করবে, তাই পৃথিবীর সব সাগর-মহাসারের অবস্থান হবে পৃথিবীর কেন্দ্রে। অন্য কোথাও কোনো জলাধারের অস্তিত্ব থাকবে না। অর্থাৎ পুরো পৃথিবীর শুধুমাত্র যে দুটো জায়গায় স্বাভাবিক মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিরাজ করবে, তার একটি (কেন্দ্র) হবে মহাসাগর, আর অন্যটি (চাকতির প্রান্তের ধারের উপর) হবে পানিবিহীন সম্পূর্ণ মরুময়।
দৃষ্টিসীমা
পৃথিবী গোল হওয়ার কারণে আমরা মাটিতে থাকা অবস্থায় যতদূর পর্যন্ত দেখতে পারি, উঁচু স্থানে উঠলে তার চেয়ে আরো অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পারি। কিন্তু পৃথিবী সমতল হলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে খুব বেশি লাভ হবে না। পৃথিবী গোল বলেই সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়ালে দূর থেকে কোনো জাহাজ যখন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, তখন আমরা প্রথমে তার মাস্তুলের চূড়াটি দেখি, এরপর পুরো জাহাজটির বিভিন্ন অংশ উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। কিন্তু সমতল পৃথিবীর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ জাহাজ একসাথে আমাদের চোখের সামনে ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকবে। এখন যেরকম প্লেনে চড়লে আমরা পৃথিবীর বক্রতা বুঝতে পারি, তখন সেরকম ঘটবে না। প্লেন থেকেও দিগন্তকে সমতল বলে মনে হবে।
প্লেন থেকে দেখলে পৃথিবীর বক্রতা বোঝা যায়: Source: TheHUB
চন্দ্রগ্রহণ
সূর্য, চাঁদ এবং পৃথিবী যদি একই সমান্তরালে আসে, তখন পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়লে সেটাকে আমরা চন্দ্রগ্রহণ বলি। পৃথিবী গোলাকার বলেই পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে দিন বা রাতের যেকোনো সময় চন্দ্রগ্রহণ উপভোগ করার সময় চাঁদের উপর গোলাকার পৃথিবীর ছায়া পড়তে দেখা যায়। কিন্তু যদি পৃথিবী সমতল হয়, তাহলে চাঁদের উপর গোলাকার ছায়া পড়ার ঘটনাটি, অর্থাৎ পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ হবে খুবই বিরল ঘটনা।
কারণ, অধিকাংশ সময়ই পৃথিবী-চন্দ্র-সূর্য একই সমান্তরালে আসার পরেও দেখা যাবে, পৃথিবীর সাথে তাদের অবস্থান এমন এক কৌণিক তলে যে, চাঁদের উপর গোলাকার পৃথিবীর ছায়া পড়া পড়ছে না, কেবলমাত্র একটি সরু দাগ দেখা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে পূর্ণ গ্রহণ কেবলমাত্র তখনই ঘটবে, যখন এদের অবস্থান একই সমান্তরালে অবস্থিত হবে এবং একইসাথে সূর্যের অবস্থান হবে পৃথিবীর উপরি পৃষ্ঠের ঠিক বিপরীত দিকে। অর্থাৎ পূর্ণগ্রহণ হবে শুধুমাত্র মাঝরাতে।
খেলাধুলার উপর প্রভাব
পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে দূরে যেতে থাকলে অভিকর্ষ তীর্যকতর হতে থাকবে; Source: VSauce/YouTube
পৃথিবী সমতল হলে খেলাধুলার উপরেও বিশাল প্রভাব পড়বে। ফুটবল খেলার সময় বল যেদিকেই নিক্ষেপ করা হোক না কেন, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে সেটি সব সময়ই গড়িয়ে পৃথিবী পৃষ্ঠের কেন্দ্রের দিকে ছুটে চলে আসতে চাইবে। কাজেই মাঠগুলোর দিক যদি হয় পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে এর প্রান্তের মধ্যবর্তী ব্যাসার্ধের অভিমুখে, তাহলে যে দল প্রান্তের দিকে থাকে থাকবে, তারা বেশি সুবিধা পাবে। ফলে সবগুলো মাঠের দিক হতে হবে ব্যাসার্ধের সাথে লম্ব অভিমুখে।
গাছপালার বৃদ্ধি
পৃথিবীতে গাছপালা বৃদ্ধি পায় মাধ্যাকর্ষণ বলের বিপরীত দিক অভিমুখে। ঋণাত্মক গ্র্যাভিট্রোপিজম নামক এক প্রকার বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি ঘটে থাকে। পৃথিবী সমতল হলে কেবলমাত্র কেন্দ্রের কাছাকাছি অবস্থিত গাছপালার বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবে হবে। কেন্দ্র থেকে দূরত্ব যত বেশি হবে, গাছপালা তত তীর্যকভাবে বেড়ে উঠতে থাকবে।