নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দ্য রেপ অব নানকিন কোথায় ও কবে সংঘটিত হয়?
শেয়ার করুন
সাইন আপ করুন
লগিন করুন
পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? আপনার ইমেইল এড্রেস দিন। ইমেইলের মাধ্যমে আপনি নতুন পাসওয়ার্ড তৈরির লিংক পেয়ে যাবেন।
আপনি কেন মনে করছেন এই প্রশ্নটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই উত্তরটি রিপোর্ট করা উচিৎ?
আপনি কেন মনে করছেন এই ব্যক্তিকে রিপোর্ট করা উচিৎ?
দ্য রেপ অব নানকিন: চীনের উপর চালানো জাপানিদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ
চ্যাং ঝি কিয়াং; বয়স মাত্র নয় বছর। মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। পথে তাদেরকে আটকে ফেলে জাপানি সৈন্যরা। তার মাকে ওরা (জাপানি সৈন্যরা) ধর্ষণ করতে চায়। কিয়াং বাধা দিলে তাকে ধরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সৈনিকরা। তারা তার মাকে বিবস্ত্র হতে বলে। কিয়াংয়ের মা তা না করলে তাকে স্তনে বেয়োনেটে দিয়ে সজোরে আঘাত করে আর তার মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মৃত ভেবে সৈন্যরা চলে গেলে কিয়াং গিয়ে তার মাকে ডেকে তোলার চেষ্টা করে। তাঁর বুকের ক্ষত পরিমাপ করতে বস্তু সরাতেই ক্ষুধার্ত ছোট ভাইটি মায়ের স্তনে মুখ দেয়। কিন্তু তার মুখ ভরে উঠে রক্তে। ততক্ষণে তাঁর মা সত্যিই না ফেরার দেশে চলে গেছে।
ঘটনাটি ১৯৩৭ সালের, চীনের নানকিন শহরের। শুধু এটিই নয়, এটি শুধুমাত্র চীনে জাপানিদের চালানো লক্ষ লক্ষ হত্যা ধর্ষণের মাত্র একটি ঘটনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হওয়ার ২ বছর আগে ১৯৩৭ সালের শেষদিকে চীনের পূর্ব জিয়াংসু প্রদেশের রাজধানী শহর নানকিং এ হামলা শুরু করে। হামলায় শহরের সৈন্য এবং নিরীহ বেসামরিক সহ হাজার হাজার লোককে হত্যা করে; আর মহিলাদের করা হয় ধর্ষণ ও নির্যাতন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের মিত্র জাপানীদের চালানো এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নাম ‘দ্য রেইপ অব নানকিং’। এই তান্ডবকে নানকিং ম্যাসাকার ও বলা হয়ে থাকে।
আক্রমণের প্রস্তুতি
চিন ও জাপানের রক্তাক্ত লড়াইয়ে জাপানীদের হাতে সাংহাইয়ের পতন হওয়ার পর চীনা সৈন্যরা পিছু হটতে শুরু করে। জাপানীদের হাতে পুরো সৈন্য বাহিনী হারানোর ভয়ে চীনা সৈন্যদের নানকিং থেকে সরিয়ে আরও ভেতরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। জাপানীদের এগিয়ে আসার খবর শুনে নানকিংয়ের অধিবাসীরা পালাতে শুরু করলে চীনা সরকার তাতে বাঁধা দেয়। জাপানীরা যখন নানকিং এসে পৌঁছায়, তখন শহরের ভেতর ৫ লক্ষ অধিবাসী বসবাস করছিল।
নানকিন আক্রমণ করার আগে জাপানিরা পথ যা পেয়েছে তাই হামলা করে ধ্বংস করেছে। পথেঘাটে সকল গ্রামের বাড়ি জ্বালিয়ে পুরিয়ে ছাড়খাড় করেছে। মহিলাদের ধর্ষণ করেছে, আর পুরুষদের কোনো কথা ছাড়াই হত্যা করেছে। মহিলাদের ধর্ষণ করার পর নির্যাতন করে হত্যা করেছে। যুবতী মেয়েদের দিনে ৬ থেকে ৭ বার ধর্ষণ করেছে।
জাপানি সৈনিকরা এক প্রকার হাটতে হাটতে নানকিন দখল করেছে। তবুও কেনো তাদের এতো নিঃসংশতা তার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন বিচিত্র উপায়ে তারা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করতো।
মুকাই এবং নদার নামে ২ জাপানিজ নিজেদের মাঝে ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতাও শুরু করেছিলেন।
এই প্রতিযোগিতায় কে কয়টি খুন করেছে তার অগ্রগতির প্রতিবেদন শীর্ষস্থানীয় জাপানী পত্রিকাগুলো প্রতিদিনের আর্কষণীয় সংবাদ হিসেবে প্রচার করেছিল, এ যেন ছিল এক আন্তর্জাতিক খেলার ফলাফল।
সেই বর্বর দুই সেনা অফিসার মুকাই এবং নদা
১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর নানকিন দখলের পর টানা ৬ সপ্তাহ জাপানিজরা সেখানে দানবীয় তান্ডব চালিয়েছে। এই ৬ সপ্তাহে তারা প্রায় ৮০,০০০ নারী ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণ করার পর তারা তাদের খুন করেছে অধিকাংশ কে। আর পুরুষদের সামনে পেলে সরাসরি হত্যা করেছে।
কেবল খুন করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। খুনের আগে যতভাবে মহিলাদের কষ্ট দেওয়া সম্ভব তার প্রায় সব বর্বরতাই জাপানীরা দেখিয়েছিল। গর্ভবতী মহিলাদের পেট কেটে খালি হাতে গর্ভের শিশুকে বের করে ফেলতো সৈন্যরা। যুবতী মেয়েদের দিনে ছয়-সাতবারও ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়। তরুণীদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের জন্য নানকিং থেকে বিভিন্ন জাপানী ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়েছিল। শিশুরাও জাপানী বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বহু শিশুকে হত্যা করা হয়।
জাপানিরা শহরটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ, নানজিংয়ের অর্ধেক ভবন লুট ও পুড়িয়ে ফেলেছিল তারা। তারা প্রথমে সম্মত হয়েছিল যে তারা নানজিং শহরের সেফটি এরিয়ায় আক্রমণ করবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, তারা তা করেনি।
রবার্ট ও. উইলসন, সেফটি জোনে কর্মরত একজন ডাক্তার তার পরিবারকে একটি চিঠিতে লিখেছেন,
বেসামরিকদের হত্যা ভয়ঙ্কর। আমি প্রায় বিশ্বাসের বাইরে ধর্ষণ এবং নৃশংসতার ঘটনাগুলি কয়েকশত পৃষ্ঠায় বর্ণনা করলেও শেষ করতে পারবো না। জাপানিজরা আমার ৭ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর মধ্যে ৫ জনকেই মেরে ফেলেছে। আর ২ জন বেয়নেট এর আঘাতে আধমরা হয়ে আছে।
এছাড়াও গত রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চীনা স্টাফ সদস্যের বাড়িতে ভাঙচুর করা হয় এবং দুই নারী, তার আত্মীয়কে ধর্ষণ করে জাপানি সৈনিকরা। একটি ৮ বছরের বাচ্চা ছেলেকে বেয়নেট দিয়ে মেরেছে। ছেলেটির শরূরে ৫ টি বেয়নেটের ক্ষত ছিল যার একটি তার পেটে প্রবেশ করেছিল, ওমেন্টামের একটি অংশ পেটের বাইরে ছিল। আমি মনে করি সে বাঁচবে।
১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে জাপানি বাহিনী ঘোষণা করে যে নানজিং-এ আদেশ পুনরুদ্ধার করা হয়েছে এবং তারা নিরাপত্তা অঞ্চলটি ভেঙে দিয়েছে। তবে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত হত্যা-ধর্ষণ বন্ধ হয়নি। শহরটির নিয়ন্ত্রণ একটি পুতুল সরকারকে দেওয়া হয়েছিল যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ অবধি শাসন করেছিল।
ভবিষ্যৎ ফলাফল
আজ অবধি, নানজিং গণহত্যায় নিহতের সঠিক সংখ্যা আমাদের কাছে নেই। অনুমান করা হয় প্রায় ২ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ নিরীহ মানুষ হত্যা করেছিল জাপানি সৈনিকরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিম পরে, দূরপ্রাচ্যের আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধের জন্য মাতসুই এবং তার লেফটেন্যান্ট তানি হিসাওকে বিচার করে দোষী সাব্যস্ত করে।
নানজিং-এর ঘটনা নিয়ে চরম ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণা আজ পর্যন্ত চীন-জাপান সম্পর্ককে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।
জাপান সরকার বহু বছর এ বর্বরতার দায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। বরং বিভিন্ন সময় চীনের প্রকাশিত সংবাদ ও তথ্যকে একপেশে হিসেবে দাবী করেছে। ১৯৯৫ সালের ১৫ আগস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তৎকালীন জাপান সরকারের প্রধানমন্ত্রী তমিচি মুরায়ামা চীনসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জাপান যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তার জন্য আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু জাপান কখনোই লিখিতভাবে নানকিং গণহত্যার জন্য চীনের কাছে দুঃখ প্রকাশ কিংবা ক্ষমা চায়নি।
২০১৫ সালে জাপানী প্রধানমন্ত্রী শিনজো এ্যাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৭০ বছর উপলক্ষ্যে যে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন তাতে চীনে জাপানের এই বর্বরতার বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়, যা চীন-জাপান সর্ম্পকে টানাপোড়ন সৃষ্টি করে।
চীন ও জাপানের সম্পর্কের টানা পোড়নে আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানী গণহত্যার প্রভাব সুস্পষ্ট।